(১৪ জানুয়ারি) নারায়ণগঞ্জ জেলার আড়াই হাজার উপজেলাধীন ব্রামন্দী ইউনিয়নের উৎরাপুর গ্রামের পাশে বয়ে চলা ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে ‘ব্রহ্মপুত্র নদের পানি ও পরিবেশ দূষণ রোধে’ মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়। যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এই মানববন্ধনের আয়োজক সংগঠন ছিল― পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা), রিভারাইন পিপল, সুবর্ণগ্রাম ফাউন্ডেশন, উৎরাপুর আদর্শ সমাজকল্যাণ সংঘ এবং পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ রক্ষা আন্দোলন।
.
উৎরাপুর আদর্শ সমাজকল্যাণ সংঘের সভাপতি মোঃ নাদিম ভূঁইয়ার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক মোঃ হামিদুল্লাহ সরকার। মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)’র আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক এবং পবা’র নারায়ণগঞ্জ জেলার সমন্বয়ক কবি ও মানবাধিকার কর্মী শাহেদ কায়েস, রিভারাইন পিপল-এর সোনারগাঁ শাখার কার্যনির্বাহী সদস্য লেখক শংকর প্রকাশ, একটিভিস্ট ও সাংবাদিক গোলাম রাব্বানী শিমুল, উৎরাপুর আদর্শ সমাজকল্যাণ সংঘের সহ-সভাপতি মোঃ আলী আশরাফ, মোঃ ওমর ফারুক লিটন, মোঃ জোনায়েদ, মোঃ নাহিদ সরকার, মোঃ সজিব মিয়া, হাজী মোঃ সিরাজুল ইসলাম খোকন, মোঃ মমতাজউদ্দিন মিয়া, মোঃ মাহবুবুর রহমান শোয়েব প্রমুখ।
.
মানববন্ধনে আলোচকরা তাঁদের বক্তব্যে বলেন― সারা দেশে দখল-দূষণে দেশের বেশিরভাগ নদী স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য হারিয়েছে অনেক আগেই। বর্তমানে নদী দখলের মাত্রা এতটাই ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে যে, অনেক নদী মরা খালে পরিণত হয়েছে। আমাদের ব্রহ্মপুত্র নদের অবস্থা এর থেকে ভিন্ন কিছু নয়। সারা দেশের নদীগুলোর মতো ব্রহ্মপুত্র নদের ভয়াবহ দূষণের বিষয়টিও বহুল আলোচিত। দেশে বিভিন্ন নদীর পানি কতটা দূষণের শিকার, রাজধানীর চারপাশের নদীগুলোর দিকে তাকালেই তা স্পষ্ট হয়। এই অঞ্চলের আশে-পাশের শিল্প-কারখানার বর্জ্য পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের পানিতে ফেলে এই ভয়াবহ দূষণের সৃষ্টি করা হচ্ছে। অপরিশোধিত তরল বর্জ্য নদীগুলোকে গ্রাস করছে। এতে নদীর জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। এ দূষিত পানি ব্যবহারের কারণে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে লোকজন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রায় ১৫ বছর ধরে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার, সোনারগাঁ ও বন্দর উপজেলার এক হাজারেরও বেশি প্রতিষ্ঠান সরাসরি ব্রহ্মপুত্র নদের পানি দূষণ করছে। এতে ব্রহ্মপুত্র নদ মাছসহ জলজপ্রাণীশূন্য হয়ে পড়েছে। স্থানীয় কৃষকরা কৃষিসেচেও নদের পানি ব্যবহার করতে পারছেন না। প্রয়োজনে কেউ নদীতে নামলে বিভিন্ন প্রকার চর্মরোগ দেখা দিচ্ছে। নদীতে মাছ না থাকায় স্থানীয় জেলেরাও তাদের কাজ হারিয়েছেন। বছরের পর বছর ধরে এমন দূষণ চললেও নদী রক্ষা কমিশন ও স্থানীয় প্রশাসন সবকিছু জেনে শুনে নির্বিকার থাকছে। আড়াইহাজার ও সোনারগাঁ অঞ্চলটি দেশের অন্যতম আর্সেনিক প্রবণ এলাকা। শত বছর ধরে এই এলাকার মানুষ মেঘনা ও পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের পানির উপর নির্ভরশীল ছিল। পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের ক্রমাগত দূষণের ফলে এই এলাকার কৃষিকাজ থেকে শুরু করে সব কাজেই ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার বেড়েছে। এতে স্থানীয় মানুষের উপর আর্সেনিকের প্রভাবও বাড়ছে। নদের মাছ হারিয়ে যাওয়ায় স্থানীয় জেলে ও দরিদ্র মানুষ বড় ধরনের সঙ্কটে পড়েছে উল্লেখ করে তাঁরা বলেন, শতাধিক জেলে পরিবার কেবল পুরোনো ব্রহ্মপুত্রে মাছ শিকার করে তাদের সংসার চালাতো। ব্রহ্মপুত্রে মাছ শিকার করে স্থানীয় দরিদ্র মানুষ পুষ্টি চাহিদা পূরণ করতো। তাছাড়া, এলাকায় হাঁস পালনে নদের ঝিনুক ও শামুকই ছিল একমাত্র ভরসা। পানি দূষণের কারনে মাছের সঙ্গে নদী থেকে শামুক ঝিনুকও হারিয়ে গেছে। ব্যঙ, সাপসহ বিভিন্ন প্রাণী হারিয়ে যাওয়ায় পরিবেশে এর বিরুপ প্রভাব পড়েছে।
.
তাঁরা আরও অভিযোগ করেন, আধিকাংশ ডাইয়িং কোম্পানি ও শিল্প-কারখানায় পানি পরিশোধন যন্ত্র নেই, কোনো কোনো কারখানায় বর্জ্য পরিশোধন যন্ত্র থাকলেও, বর্জ্য পরিশোধন না করে সরাসরি তা ফেলে দেয়া হয় নদীর পানিতে। এতে বিভিন্ন ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ আমাদের খাদ্যচক্রে প্রবেশ করছে। কোনো কোনো রাসায়নিক পদার্থ মানব স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। শাহেদ কায়েস তার বক্তব্যে বলেন, ‘সারাদেশেই নদীগুলোকে হত্যা করা হচ্ছে। পুরাতন ব্রহ্মপুত্রও এর বাইরে নয়। সমাজের প্রতিটি মানুষকেই এসব নদী রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।’
.
মানববন্ধনে বক্তারা স্থানীয় প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তর ও সরকারের কাছে দাবি জানান, শিল্প-কারখানার রাসায়নিক পদার্থের সামান্য অংশও যাতে আমাদের খাদ্যচক্রে প্রবেশ করতে না পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। এ অবস্থায় ব্রহ্মপুত্র নদ দূষণ রোধে সরকারকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। সারা দেশের শিল্প-কারখানায় এসব ক্ষেত্রে বিদ্যমান অনিয়মগুলো খুঁজে বের করতে দেরি করা হলে দেশের বিভিন্ন নদীর বিস্তীর্ণ এলাকায় দূষণ ছড়িয়ে পড়বে। ব্রহ্মপুত্রসহ দেশের সব নদীর স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য ফিরিয়ে আনতে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।