দিলীপ রায় ঃ পদ্মা নদী বাংলাদেশের প্রধান নদী । পদ্মা হিমালয় (হিমালয়ের গঙ্গোত্রী
হিমবাহ) থেকে উৎপন্ন গঙ্গা (ভাগীরথী গঙ্গা) নদীর প্রধান শাখা নদী ।
বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ শহর রাজশাহী পদ্মা নদীর উত্তর তীরে অবস্থিত ।
পদ্মার সর্বোচ্চ গভীরতা ১৫৭১ ফুট এবং গড় গভীরতা ৯৬৮ ফুট । পদ্মা নদীটি
১২০ কিমি দীর্ঘ এবং ৪ থেকে ১০ কিমি প্রশস্ত এবং নদীটির প্রকৃতি
সর্পিলাকার । শোনা যায়, পদ্মা নদীর আগের নাম ছিল কীর্তিনাশা নদী ।
পদ্মা নদীর প্রধান উপনদী মহানদী এবং পুনর্ভবা । পদ্মার বিভিন্ন শাখা
নদীর মধ্যে গড়াই, বড়াল আড়িয়াল খাঁ, কুমার, মাথাভাঙ্গা, ইত্যাদি অন্যতম ।
পদ্মা নদী মূলত গঙ্গার নিম্ন স্রোতধারার নাম । । অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ
গোয়ালন্দ – চাঁদপুর স্টিমার চলাচল পথের অধিকাংশই এই নদী জুড়ে । শোনা যায়
হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে উৎপন্ন গঙ্গা নদী রাজশাহী জেলা দিয়ে
বাংলাদেশে প্রবেশ করে এবং এখান থেকেই নদীটি পদ্মা নাম ধারন করেছে ।
অপরদিকে গঙ্গা, ভাগীরথী নামে ভারতে হুগলীর দিকে প্রবাহিত হয়েছে । আরও
জানা যায়, গোয়ালন্দে যমুনা নদীর সাথে মিলিত হয়ে মিলিত প্রবাহ পদ্মা নামে
পূর্ব দিকে চাঁদপুর জেলায় মেঘনা নদীর সাথে মিলিত হয়েছে । সবশেষে
পদ্মা-মেঘনা মিলিত প্রবাহ দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরে মিলিত হয় ।
সেই পদ্মা নদীতে বহু প্রতীক্ষিত পদ্মা সেতু । পদ্মা সেতু
বাংলাদেশের পদ্মা নদীর উপর নির্মিত একটি বহুমুখী সড়ক ও রেল সেতু ।
প্রমত্তা ও খরস্রোতা পদ্মা নদী । তার উপর সেতু । এক দশক আগেও পদ্মা নদীতে
ব্রিজ তৈরী স্বপ্ন ছিল । বহু প্রতীক্ষিত সেই স্বপ্ন, জাতির পূরণ হতে
যাচ্ছে । ২৫শে জুন উদ্বোধন হতে যাচ্ছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু । পদ্মা সেতু
পদ্মা নদীর উপর বহু আকাক্ষিত বহুমুখী সড়ক ও রেল সেতু । দুই স্তর বিশিষ্ট
স্টীল ও কক্রিট নির্মিত ট্রাস, এই ব্রিজটির উপরে থাকবে চার লেনের সড়ক পথ
এবং নীচের স্তরে থাকবে একটি একক রেল পথ । পদ্মা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা নদীর
অববাহিকায় ৪২টি পিলার, ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের ৪১টি স্প্যানের মাধ্যমে মূল
অবকাঠামো তৈরী করা হয়েছে ।
পদ্মা সেতুতে যে পাথর ব্যবহৃত হয়েছে তার এক একটির ওজন এক টন ।
পাথর ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্য থেকে আমদানি করা হয়েছে । সেতুর পাইলিং ১২২
মিটার গভীরে স্টীলের পাইল বসানো হয়েছে । এইসব পাইল তিন মিটার ব্যাসার্ধের
। বিশ্বের এখনও পর্যন্ত কোনো সেতুর জন্য এত গভীরে পাইলিং হয়নি । এবার
আসছি ভূমিকম্পের বিয়ারিংয়ে । পদ্মা সেতুতে ফিকশন পেণ্ডুলাম বিয়ারিং
লাগানো হয়েছে । যার সক্ষমতা ১০,০০০ টন । এখনও বিশ্বের কোনো সেতুতে এত
ক্ষমতার বিয়ারিং লাগানো হয়নি । রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রার ভূমিকম্পেও টিকে
থাকতে পারবে এই পদ্মা সেতু । নদী শাসনে চীনের ঠিকাদার সিনেহাইড্রো
কর্পোরেশনের সঙ্গে ১১০কোটি মার্কিন ডলার চুক্তি হয়েছে । এর আগে
নদীশাসনে এককভাবে এত বড় দরপত্র বিশ্বে আর হয়নি । নদীশাসনের আর একটা
রেকর্ড হল, ১৪ কিলোমিটার (১.৬ কিমি মাওয়া প্রান্তে ও ১২.৪ কিমি জাজিরা
এলাকা নদীশাসনের আওতায় আনা হয়েছে । পদ্মা সেতু প্রকল্প তিন জেলায় বিস্তৃত
। মুন্সিগঞ্জের মাওয়া, শরীয়তপুরের জাজিরা, এবং শিবচর । এছাড়া পদ্মা
সেতুতে পাইলিংয়ে অতি মিহি সিমেন্ট ব্যবহার করা হয়েছে । এইসব সিমেন্ট
অস্ট্রেলিয়া থেকে আনা হয়েছে । এই সেতুটির নকশাকার হচ্ছে এ-ই-সি-ও-এম এবং
নির্মাণকারী সংস্থা হচ্ছে চীন মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন
কোম্পানী লিঃ । ব্রিজটির নির্মাণ শুরু হয়েছিল ২০১৪ সালের নভেম্বরে এবং
নির্মাণ শেষ ২০২২ সালের জুন মাসে । আনুমানিক নির্মাণ ব্যয় প্রায় ৩০,৭৯৩
কোটি ৩৯ লক্ষ টাকা । অন্যান্য বিশেষত্বঃ- পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য ৬.১৫
কিলোমিটার । ডাঙার অংশসহ সেতুটির মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ৯ কিলোমিটার । দ্বিতল
পদ্মা সেতুর এক অংশ থাকবে মুন্সিগঞ্জের মাওয়ায়, আর এক অংশ শরীয়তপুরের
জাজিরায় । পদ্মা সেতুতে সিসি ক্যামেরা থাকছে । সেতুতে সাধারণ আলোর
ব্যবস্থা ছাড়াও আর্কিটেকচার লাইটিং থাকছে । বিশেষ বিশেষ দিনে বা বিশেষ
বিশেষ সময়ে লাইটিংয়ের মাধ্যমে শোভা বর্ধন করা হবে । নদীর জল থেকে পদ্মা
সেতুর উচ্চতা ১৮ মিটার । সুতরাং নৌ-যান চলাচলে সমস্যা থাকবে না । পদ্মার
মতো স্রোতস্বিনী এমন নদীর উপর বিশ্বে সেতু হয়েছে মাত্র একটি, যেটা আমাজন
নদী ।
এবার দেখা যাক, অর্থনৈতিক দিক দিয়ে পদ্মা সেতুর গুরুত্ব কতখানি ?
অর্থনৈতিক গুরুত্ব প্রস্তাবিত পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প মাওয়া-জাজিরা
পয়েন্ট দিয়ে নির্দিষ্ট পথের মাধ্যমে দেশের কেন্দ্রের সাথে দক্ষিণ-পশ্চিম
অংশের সরাসরি সংযোগ তৈরী করবে । পদ্মা বহুমুখী সেতু শুধু
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নয়, পুরো বাংলাদেশের অর্থনীতি বদলে দেবে । এই সেতু
দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যোগাযোগ, বাণিজ্য, পর্যটনসহ অনেক
ক্ষেত্রেই উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাতে চলেছে । সব মিলিয়ে এই সেতু জনগণের
স্বপ্নের সেতু হয়ে উঠবে । এই সেতু অপেক্ষাকৃত অনুন্নত অঞ্চলের সামাজিক,
অর্থনৈতিক ও শিল্প বিকাশে উল্লেখযোগ্যভাবে অবদান রাখবে । প্রকল্পটির ফলে
প্রত্যক্ষভাবে প্রায় ৪৪০০০ বর্গ কিমি বা বাংলাদেশের মোট এলাকার ২৯% অঞ্চল
জুড়ে ৩ কোটিরও অধিক মানুষ উপকৃত হবে । ফলে প্রকল্পটি দেশের পরিবহন
নেটওয়ার্ক এবং আঞ্চলিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ
অবকাঠামো হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে ।
পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের একটা গুরুত্বপূর্ণ সমন্বিত
যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে । বাংলাদেশের কৃষি ব্যবস্থাতে অনেক উন্নতি
ঘটবে । বিশেষ করে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষি ব্যবস্থার প্রভুত উন্নতি
ঘটবে । এমনিতেই দক্ষিণ পশ্চিঞ্চাল কৃষিতে উন্নত । বেনাপোলের সঙ্গে
বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গার সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত থেকে উন্নততর হবে
। অনেকের ধারণা, পুরো দেশের অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়বে । কৃষি, শিল্প,
অর্থনীতি, শিক্ষা, বাণিজ্য সব ক্ষেত্রেই পদ্মা সেতুর প্রভাব অনিবার্য ।
পদ্মা সেতুর ফলে পর্যটন শিল্পে নতুন মাত্রা যোগ হচ্ছে । পর্যটন ব্যবস্থা
উন্নত হলে হোটেল রেঁস্তোরা আরও বাড়বে ।
এবার আসা যাক পদ্মা সেতুর কারণে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে
বাংলাদেশের সম্পর্কের জায়গাগুলিতে । উপরে যথারীতি বর্ণিত যে, বেনাপোল
থেকে বাংলাদেশের সমস্ত জায়গার যোগাযোগ ব্যবাস্থার প্রভুত উন্নতি ঘটবে ।
ফলে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা যে আরও উন্নতি ঘটবে চোখ
বুজে সেটা অনুধাবন করা যায় । ভারত-বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও মধুর
হবে । ভারত থেকে অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্য যেমন পিয়াঁজ, ইত্যাদি আমদানীর
ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অনেক সুবিধা হবে । আগে যাতায়াতের খরচা ছিল অনেক,
তেমনি দ্রব্যসামগ্রী পৌঁছাতে সময় লাগতো । পদ্মা সেতুর জন্য সড়ক ও রেল পথে
ভারতে থেকে বাংলাদেশের যে কোনো জায়গায় অনায়াসে পৌঁছানো যাবে এবং সেটা কম
খরচায় ও কম সময়ে । এই সুবিধাগুলি বাংলাদেশের কাছে একটা বড় পাওনা । তা
ছাড়া পর্যটন শিল্পেও ভারতের সঙ্গে একটা সুসম্পর্ক গড়ে ওঠার প্রবণতা বাড়বে
বই কমবে না । ফরিদপুর, মাদারীপুর, ঢাকা যেতে এখন দুঃশ্চিন্তায় মাথায়
হাত দিয়ে বসে পড়তে হবে না । সমস্ত দিক মাথায় রেখে এটা বলা যায়। পদ্মা
সেতুর কারণে ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী বন্ধন আরও সুদৃঢ় হবে ।
পদ্মা সেতু হচ্ছে বাংলাদেশের স্বপ্ন, সাহস ও সক্ষমতার প্রতীক ।
তেমনি পদ্মা সেতু হচ্ছে বাংলাদেশের অহংকারের প্রতীক । পদ্মা সেতুর
মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিকাঠামো আরও উন্নত হোক এবং বাংলাদেশের
মানুষের সামাজিক, অর্থনৈতিক অবস্থার আরও উন্নতি ঘটুক । সমানভাবে এটাও আশা
রাখছি, পদ্মা সেতুর জন্য ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক আরও মজবুত হোক এবং
বাণিজ্যিক সম্পর্কের বহুত উন্নতি ঘটুক ।