মীর আব্দুল আলীম ঃদেখতে দেখতেই কেটে গেল আমার জীবনের অর্ধশত বছর। আমি আর দেশটা যে সমবয়সী।
কালে কালেতো অনেক কিছুই দেখলাম। এই মৃত্যু-উপত্যকা কিছুতেই আমাদের দেশ
না। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন করা এই দেশ এটা না।
ঘুষখোর,দুর্নীতিবাজ, চোর বাটপারের এমন দেশ উপহার দিতে চাননি বঙ্গবন্ধু।
তার তনয়া বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রীও শত চেষ্টায়ও রুখতে পারছেন না
লুটেরাদের। গুটিকয়েক সৎ আর পুরোটাই অসতের রাজ্যে ভাসছে গোটা বাংলাদেশ।
মাঝে মাঝে ভাবি এটা আসলেই কি আমরা সদ্যপ্রায়ত মুক্তিযোদ্ধা বাবার প্রাণের
বাংলাদেশ? যদি বলি আজ যে দেশ আমরা দেখছি তা কেবলই তপ্ত অগ্নিকুন্ড,
ঘুষখোর,মজুদদার, পাপিষ্ঠ আর চাপাবাঁজদের দেশ? স্বাধনিতার ৪০ বছর ধরেই
রাজাকার আর আলবদরদের অঘোষিত রাজত্ব ছিল দেশটাতে; দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাসী,
খুনিতে ভরা ছিলো দেশ? এখন খুনখারাবি কমেছে কিছুটা। তাতে কি? মানুষের
জানমাল এখনও নিরাপদ নয়। এমন দেশতো লাখো মানুষের রক্ত আর হাজারো নারীর
সম্ভ্রমের বিনিময়ে পাওয়া দেশ নয! এটা মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাধীন করা সেই
দেশ নয়। মুক্তিযোদ্ধারা দেশের জন্য জীবন বিসর্জন দিয়েছেন স্বাধীন একটা
দেশ পেতে। তাঁদের স্বপ্ন ছিল সোনার বাংলা হবে এদেশ। এদেশে সোনা ফলছে ঠিকই
যুগেযুগে লুটেরা তা লুটে নিচ্ছে। দেশে স্বাভাবিক মৃত্যও কেন কোন
গ্যারান্টি নেই আজ। আমরা কেন কোথাও নিরাপদ নই? ঘরেও না; বাহিরেও না। নিজ
ঘরে থাকবেন? সাগর-রুনী অথবা ফরহাদ দম্পতিদের মত খুন হবেন। বিচার হবে না
যুগ পেরিয়ে গেলেও। রাস্তায় যাবেন? দানবীয় বাস ট্রাক কেড়ে নেবে জীবন।
লঞ্চে চড়বেন ডুবে মরবেন। কর্মস্থলে থাকবেন? সর্বনাশা আগুনে যে আঙ্গার
হবেন না তার নিশ্চয়তা কোথায়?
এদেশের মানুষের কোনো নিরাপত্তা নেই, কোনো স্বাভাবিক গ্যারান্টি নেই
জীবনের, যখন যেখানে সেখানে মৃত্যু। ফ্লাইওভার ভেঙে পড়ছে, ব্রিজ ভেঙ্গে
পড়ছে, বিল্ডিং ভেঙে পড়ছে, হেলে পড়ছে। এইতো হচ্ছে দেশে। যা কিছু মানুষের
সৃষ্টি, সবই ভেঙে পড়ে মানুষের ওপর। ভাগ্যিস আকাশটা সৃষ্টিকর্তার গড়া ছিল!
তা না হলে সেটাও যে ভেঙে পড়ত ঘাড়ে। সীমান্ত হত্যা, গুম ,খুন, আর
ক্রসফায়ারে ভয়াল মৃত্যু আজ ওৎ পেতে আছে আমাদের সামনে। আজ স্বাভাবিক
মৃত্যুই যেন অস্বাভাবিক। মানুষকে মানুষ মারছে নির্দয়ভাবে। শত শত মানুষ
আগুনে দগ্ধ হয়ে পুড়ে, মরছে নানা দুর্ঘটনায়। পথে ঘাটে এমনকি বাসাবাড়িতে
মানুষ খুন হচ্ছে। পদে পদে দুর্নীতি হচ্ছে। রোধ হচ্ছে না।
প্রধান মন্ত্রী কোন এক দিন তাঁর বক্তব্যে বলেছেন- “বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন
পূরণ না হওয়া পর্যন্ত বিশ্রাম নেবো না”। সে লক্ষেই তিনি কাজ করে যাচ্ছেন।
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন আসলেও পূরণ করতে পারিনি আমরা। সভ্য মানুষের বাংলাদেশ
এখনও হয়নি। সে সময় যেমন বঙ্গবন্ধু তাঁর কম্বলের সন্ধান না পেয়ে কম্বল
চোরদের নিয়ে কটুক্তি এবং হুশিয়ারী উচ্চারন করেছিলেন। অর্ধশত বছর পরেও সেই
চোরের দল এখনও বহাল তবিয়তে। চোর দুনীতিবাজদের কাছ থেকে দেশ মুক্তহলে
বাংলাদেশ সোনার দেশ হবেই। আর সেই দিনটার প্রত্যাশায় আছি।
মুক্তিযুদ্ধের কথা এলেই যার নাম আগে নিতে হয় তিনি সেই মহান নেতা
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাকে ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে স্বরণ করতেই
হয়। লজ্জার সঙ্গে বলতে হয় যারা তার ডাকে সাড়া দিয়ে যুদ্ধ করেছিলেন দেশের
জন্য; পরাধীনতা থেকে মুক্ত করে স্বাধীনতা দিয়েছেন বাঙালি জাতিকে সেই মহান
ব্যক্তিদের নিয়ে; সেই স্বাধীনতা নিয়েই, আজও যুদ্ধ চলছে দেশে। এদেশের
মানুষ স্বাধীনতা চেয়েছিল স্বাধীনভাবে বাঁচার জন্য; পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে
মুক্ত হতে; স্বাধীনভাবে একটু কথা বলতে; একটু মুক্ত জীবনের আশায়। এটাতো
মোটেও সেই স্বাধীনতা নয়। প্রশ্ন জাগে ৫১ বসন্ত পার করা আমাদের এই
স্বাধীনতাই কি সেই স্বাধীনতা? আমাদের প্রত্যাশিত স্বাধীনতাই কি আজকের এই
স্বাধীনতা? মিথ্যা বলার জন্যই কি স্বাধীনতা? স্বাধীনতার ঘোষক বিতর্ক তুলে
জাতির জনককে অসম্মানিত করার জন্যই কি স্বাধীনতা?
১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ দিবাগত রাতে বাঙ্গালীদের উপর চলে অতর্কিত হামলা।
২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধ শেখ মুজিবর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা
ঘোষনা দেন। ২৭ মার্চ জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে
চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের
উদ্দেশ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণের ডাক দেন। তাঁরা
সবাই দেশ স্বাধীন করতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। মূলত ১৯৭১ সালের ১ থেকে ২৬ মার্চ
পর্যন্ত এই ২৬ দিনেই বাংলাদেশ প্রকৃতপক্ষে স্বাধীন জাতিতে পরিণত হয়েছিল,
যার ফলে কখন স্বাধীনতা ঘোষিত হয়েছিল বা কে তা ঘোষণা করেছিল এ প্রশ্নটি
অবান্তর, অপ্রাসঙ্গিক এবং ঐতিহাসিক বাস্তবতাকে অগ্রাহ্য করার যে প্রবণতা
আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনাকে গ্রাস করেছে এটা তারই আরেকটি দৃষ্টান্ত;
সত্যানুসন্ধান চিরায়ত ও সর্বজনীন প্রক্রিয়া। সত্যকে জানবার ও উদ্ঘাটনের
প্রয়াসে মানুষ নিরন্তর নিয়োজিত, কিন্তু সত্যানুসন্ধান অত্যন্ত কঠিন কাজ,
এ প্রয়াস প্রায়ই বিপথগামী হতে পারে আবেগ ও বিশ্বাসের কারণে। আর তাই হচ্ছে
আমাদের দেশে। স্বাধীনতার এতটা বছর পরও চলছে স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে
দ্বন্দ্ব। ঘোষণাতো ৭ মার্চেই হয়েছে। তবুও স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে বিতর্ক
দীর্ঘ দিনের। আসলে স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে কোন রকম আলোচনা কিংবা দ্বিমত
কিংবা বিভাজন মুক্তিযুদ্ধের সময় কিন্তু ছিল না। এটা শুরু হয় স্বাধীন
হওয়ার অনেক পর থেকে। স্বাধীনতা সংগ্রামীরা মুক্তির যে শিখাটি প্রজ্বলিত
করেছেন তাকে অনির্বাণ রাখতে তরুণ সমাজের দায়িত্বই সমধিক। তাদের
স্বাধীনতার সংগ্রামের আদর্শ, শহীদদের আত্মদান, দেশপ্রেম ও দেশ গড়ার
প্রত্যয় নিয়ে উদ্বুদ্ধ করতে পারলে তারাই সন্ত্রাস, দুর্নীতিমুক্ত
বাংলাদেশের ভিত রচনা করবে। বাংলাদেশের ইতিহাসকে কি কখনও বিকৃত করা যাবে?
মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং যে বিরাট সংগ্রামী ঐতিহ্যের অধিকারী এই বাঙালি
জাতি, তাদের নিয়ে কি কোনো ধূম্রজাল সৃষ্টি করা কারও পক্ষে সম্ভব হবে?
অবান্তর বিতর্ক, কোন্দল, হানাহানী,দুর্নীতি দেখে মাঝে মাঝে ভাবি কিসের
জন্য এই স্বাধীনতা? যে স্বাধীনতা দেশবাসী প্রত্যক্ষ করছে তা স্বাধীনতা
নয়। তাইতো আজ শিল্পীরা গায়- “বলার জন্য কি বলছি; শোনার জন্য কি শুনছি; ৩৫
বছর পরেও আমি স্বাধীনতাটাকেই খুঁজছি।” এত বছর পর কেন স্বাধীনতাটাকে
খুঁজতে হয়- এ প্রশ্নের উত্তর কারোই হয়তো জানা নেই। মাত্র ৯ মাসের
ব্যবধানে বিজয় ছিনিয়ে এনে এ দেশের বীরজনতা বুঝিয়ে দিল, ঐক্য ও ত্যাগ
থাকলে বুলেট আর কামান দিয়ে কোনো জাতিকে দমিয়ে রাখা যায় না। আমরা স্বাধীন
হয়েছি ঠিকই, স্বাধীনতার ৫১ বছর পর প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। আমাদের প্রকৃত
মুক্তি কি অর্জিত হয়েছে? বালিস, পর্দামার্ক কাহিনী উন্নয়নের সুনাম সব
ম্লান করে দিচ্ছে। এদেশের মানুষের প্রকৃত মুক্তি অর্জিত হয়নি ইতিহাসই তা
আজ সাক্ষ্য দিচ্ছে। এখনও অর্জিত হয়নি অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক
স্বাধীনতা। একদল শোষকের স্থান নিয়েছে আরেকদল শোষক। মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্খা
একটি শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা আজও গড়ে তোলা যায়নি। স্বাধীনতা, লাল সবুজের
পতাকা আর মানচিত্রের আড়ালে আমাদের উপর চেপে বসে আছে সাম্রাজ্যবাদ,
সমপ্রসারণবাদসহ বিদেশিদের ও তাদের এদেশিয় দালালদের নির্মম শোষণ। অথচ
স্বাধীনতার ইতিহাস কতই না কষ্টার্জিত। কত যাতনা ভরাই না এ ইতিহাস। দেশে
এখনও যুদ্ধ চলছে। এ যুদ্ধ শেষ কোথায়? বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে
সাড়া দিয়ে এদেশের আমজনতা মুক্তিযুদ্ধ করেছে। তিনি অবিস্মরণীয়। তখন
রাজাকার ছিল হাতে গোনা ক’জন মাত্র। খারাপতো সর্বকালেই বিরাজমান। এখনও সেই
খারাপে দল আছে, তবে ভিন্ন রূপে। বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসে
নিঃসন্দেহে সবচেয়ে মহত্তম ও গৌরবময় ঘটনা আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। বাংলাদেশের
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস একদিকে যেমন করুণ, শোকাবহ, রোমহর্ষক, তেমনি ত্যাগের
মহিমায় উজ্জ্বল ও বীরত্বপূর্ণ। ১৯৭১ এর মহান সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের নয়
মাসের প্রতিটি দিনই কোনো না কোনোভাবে তাৎপর্যবহ। মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি
জাতির আনন্দ ও বেদনার এক সংমিশ্রিত ইতিহাস। মাত্র ৯ মাসের স্বাধীনতা।
স্বাধীনতা কি এতই সস্তাা?
স্বাধীনতা অর্জনে অনেক ত্যাগ রয়েছে। শুধু ৭১-এ এই যুদ্ধ হয়নি। স্বাধীনতার
জন্য আরও বহু আগে থেকেই যুদ্ধে নামতে হয়েছে বাঙালি জাতিকে। যাদের বয়স
ষাটোর্ধ্ব তারা দেখেছেন আর আমরা শুনেছি ১৯৫৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত
সাধারণ নির্বাচনের জন্য আওয়ামী লীগকে বেশ ভালোভাবেই প্রস্তত করে নেন
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সাধারণ নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হতে
পারে সম্ভবত এ আশঙ্কা থেকেই ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর সামরিক বাহিনীর
সহযোগিতায় রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন ইস্কান্দার মীর্জা। কিন্তু সামরিক
জান্তার পুতুল ইস্কান্দার মীর্জাকে ক্ষমতা দখলের ২০ দিনের মাথায় দেশ থেকে
বিতাড়ন করে প্রধান সেনাপতি জে. আইয়ুব খান সামরিক আইন জারির মাধ্যমে
সর্বময় ক্ষমতা করায়ত্ব করেন। সে সময় শেখ মুজিবসহ পূর্ব পাকিস্থানের আরও
অনেককে জেলে নেয়া হয়। নির্যাতন করা হয়। জেল থেকে মুক্তি লাভের পর সামরিক
আইনের বেড়াজালের মধ্যেও মুজিব দলকে গোছাতে থাকেন। হোসেন শহীদ
সোহরাওয়ার্দী ১৯৬৪ সালের ৫ ডিসেম্বর ইন্তেকাল করেন। সোহরাওয়ার্দীর
মৃত্যুর পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব দলকে পুনরুজ্জীবিত করেন। শেখ মুজিব এ সময়
একটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১৯৬৬ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি লাহারে
পাকিস্থানের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর এক সম্মেলনে শেখ মুজিব পূর্ব বাংলার
স্বায়ত্তশাসনের দাবি ৬ দফা পেশ করেন। মুজিব জানতেন, পাকিস্থান সামরিক
চক্র ৬ দফা দাবি মেনে নেবে না। আর এ ৬ দফা দাবি একদিন এক দফা অর্থাৎ
স্বাধীনতার দাবিতে পরিণত হবে।
মুজিবের ৬ দফা ১৯৬৬-এর মার্চে অনুষ্ঠিত দলীয় সম্মেলনে ইশতেহার হিসেবে
গ্রহণ করা হয়। শেখ মুজিব এবং তার দলের নেতারা ৬ দফা দাবি প্রচারের জন্য
সারাদেশ চষে বেড়ান। ৬ দফা পেশের পর প্রেসিডেন্ট আইয়ুব হুমকি দেন। শেখ
মুজিবকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে চিহ্নিত করে সামরিক জান্তা। ৬ দফা
প্রচারকালে শেখ মুজিবকে বেশ কয়েকবার গ্রেফতার করা হয়। এ সময় সারাদেশে
আওয়ামী লীগ ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগের শত শত নেতা-কর্মী গ্রেফতার হন।
নির্যাতনের কাছে মাথা নত না করায় শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা
ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। ১৯৬৪ সালের ১ জানুয়ারি নয়া ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হয়। ১৭ জানুয়ারি গভীর রাতে শেখ মুজিবকে
রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে এ ষড়যন্ত্র মামলায় নতুনভাবে গ্রেফতার দেখিয়ে
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হলো।
রাষ্ট্রদ্রোহী মামলায় ৩৫ জন আসামির ১ নম্বর আসামি করা হয় আওয়ামী লীগ
সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে। রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে শেখ মুজিবকে
ফাঁসিতে হত্যা করাই ছিল শাসকচক্রের মূল লক্ষ্য। আইয়ুব-মোনায়েম চক্রের এই
উপর্যুপরি ষড়যন্ত্র ও নির্যাতনের কারণে আপসহীন শেখ মুজিব জেলে থেকেই
বাংলার মুক্তিকামী মানুষের একক নেতায় পরিণত হন। এ সময় শেখ মুজিব ও
রাজবন্দীদের মুক্তিসহ ১১ দফা দাবিতে ছাত্র-জনতা আন্দোলন শুরু করে। এই
আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। জনতার কাছে নতি স্বীকার করে ১৯৬৯ এর ২২
জানুয়ারি তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের মাধ্যমে শেখ
মুজিবসহ রাজবন্দীদের মুক্তি দেয়া হয়।
২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে স্মরণকালের সর্ববৃহৎ সংবর্ধনা সভায় শেখ
মুজিব বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত হলেন। ১৯৬৯ এর ২৫ মার্চ দশ বছরের
স্বৈরশাসনের ইতি ঘটিয়ে আইয়ুব খান পদচ্যুত হন এবং জে. ইয়াহিয়া খান সামরিক
আইন জারির মাধ্যমে পুনরায় ক্ষমতা দখল করেন। বাঙালির পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ও
চাপের মুখে জে. ইয়াহিয়া নির্বাচন দিতে বাধ্য হন। ১৯৭০ এর ৭ ডিসেম্বর
অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পূর্ব বাংলায় ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭ আসন
পেয়ে সারা পাকিস্থানে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে শেখ মুজিবুর
রহমানের আওয়ামী লীগ। ১৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে
৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮টি পায় বঙ্গবন্ধুর দল। পূর্ব বাংলার জনগণের প্রায় ৯৫
শতাংশ ভোট পেয়ে মুজিবের আওয়ামী লীগ নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করল। নির্বাচনের
পর ৩ জানুয়ারি জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের রেসকোর্স ময়দানে
শপথ গ্রহণ করান বঙ্গবন্ধু। নির্বাচনের পর পাকিস্তানি সামরিক জান্তা বিজয়ী
দল আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তাান্তরে গড়িমসি শুরু করে। ২৬ মার্চ রাত
১টা ১০ মিনিটের দিকে একটি ট্যাংক, একটি সাঁজোয়া গাড়ি এবং কয়েকটি ট্রাক
বোঝাই সৈন্য শেখ মুজিবের বাড়ির ওপর দিয়ে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে রাস্তা ধরে
এগিয়ে আসে এবং তাকেসহ ৪ জন চাকর এবং একজন দেহরক্ষীকে গ্রেফতার করে। এ সময়
তারা বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সীমানার পাশে লুকিয়ে থাকা একজন সৈন্য প্রহরীকে খুন
করে। ২৬ মার্চ রাত তিনটার দিকে চট্টগ্রাম থেকে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন মেজর
জিয়া। আর সেই সঙ্গে নির্দেশ পাঠান ব্যাটালিয়নের সব পশ্চিমা অফিসারকে
গ্রেফতারের। কেবলই ৯ মাস নয় সুদীর্ঘ ২৩ বছরের আন্দোলন সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু
মুজিবের নেতৃত্বে বাংলার সাড়ে ৭ কোটি মানুষ স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে
এনেছে। জাতি অর্জন করেছিল একটি জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সঙ্গীত।
স্বাধীনতা মানে ইচ্ছার স্বাধীনতা, রাজনীতির স্বাধীনতা এবং অবশ্যই
অর্থনৈতিক মুক্তি। বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে স্পষ্টভাবেই
উচ্চারণ করেছিলেন- ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম
মুক্তির সংগ্রাম’। পাকাস্থানীদের জুলুম নির্যাতন থেকে মুক্তি সেসঙ্গে
অর্থনৈতীক মুক্তির কথাই বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু। আমরা পাকিস্থান থেকে মুক্ত
হয়েছি কিন্তু এেেদশের কতক অসভ্য মানুষের হাত থেকে কিছুতেই মুক্তহতে
পারিনি আমরা। এই মুক্তির সংগ্রামে জয়ী হওয়ার লক্ষ্যে আমাদের তরুণ প্রজন্ম
একাত্তরের মুক্তিসংগ্রামীদের মতোই স্বপ্ন ও সাহস নিয়ে এগিয়ে আসুক এটাই
প্রত্যাশা।
লেখক- মীর আব্দুল আলীম, সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সমাজ গবেষক।