September 19, 2024, 7:50 am

জেলেদের নৌকায় ডাকাতি, লুণ্ঠন ও অপহরণের ঘটনায় জড়িত দস্যুদলের মূল সমন্বয়কারীসহ ০৫ ডাকাত গ্রেফতার

প্রেস বিজ্ঞপ্তি: পাথরঘাটা, বরগুনা ও পটুয়াখালী সংলগ্ন উপক‚লীয় এলাকার ৩০ থেকে ৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে দূরবর্তী বঙ্গোপসাগরের অভ্যন্তরে বেশ কয়েকটি দস্যুতার ঘটনা ঘটে। যেখানে দস্যুরা মাছ ধরার ট্রলারে হামলা করে জেলেদের অপহরণ, লুণ্ঠন ও মুক্তিপণ দাবী করেছে বলে জানা যায়। এছাড়া সুন্দরবনে পার্শ্ববর্তী দেশের সাথে সীমান্তবর্তী এলাকায় গুলিতে একজনের নিহতের ঘটনা ঘটে।

২। গত নভেম্বরের মাঝামাঝিতে পিরোজপুর, পটুয়াখালী ও বরগুনা হতে ভিকটিমরা তাদের সহকর্মীসহ মাছ ধরার উদ্দেশ্যে গভীর সমুদ্রে গমণ করে। গত ২০ নভেম্বর ২০২১ তারিখ সকাল ০৭০০ ঘটিকা হতে রাত ২২০০ ঘটিকার মধ্যে পাথরঘাটা, বরগুনা ও পটুয়াখালী (বলেশ্বর ও পায়রা মোহনা) বঙ্গোপসাগরের তৎসংলগ্ন ৩০-৫০ কিঃ মিঃ অভ্যন্তরে অপহরণের স্বীকার হয়। ভিকটিমরা স্ব স্ব নৌকা নিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে অবস্থান করছিল। জলদস্যুরা ক্রমান্বয়ে একটির পর একটি নৌকায় ডাকাতি করে। অতঃপর জলদস্যুরা ভিকটিমদের সহকর্মীদের মুক্তিপণের অর্থ জানিয়ে দিয়ে ভিকটিমদের নৌকাযোগে ফেরত পাঠায়। কিন্তু দস্যুরা ভিকটিমদের একটি নৌকা রেখে দেয়, যা ডাকাতির কাজে ব্যবহার করে। এছাড়া ভিকটিমদের নিকট হতে লুন্ঠনকৃত মাছ, জাল এবং তৈল ডাকাতদের নৌকার মাধ্যমে নিয়ে যাওয়া হয়। মোবাইলসহ মূল মাঝি ও কয়েকজন সদস্যকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। অতঃপর ভিকটিদের মোবাইল নম্বর হতে তাদের পরিবারের সদস্যদের সাথে যোগাযোগ করে ভয়ভীতি দেখিয়ে মুক্তিপণ দিতে চাপ প্রয়োগ করে জলদস্যুরা।

৩। বর্ণিত ঘটনাগুলোর গুরুত্ব অনুধাবন পূর্বক র‌্যাব চতুর্মুখী উদ্যোগ নেয়। র‌্যাব আভিযানিক ও গোয়েন্দা নজরদারী বৃদ্ধি করে। র‌্যাব-৮ এর আভিযানিক দল বঙ্গোপসাগরের অভ্যন্তরে ও সমুদ্রের নিকটবর্তী চরাঞ্চল যেমন; ডালচর, সোনার চর, চর মন্তাজসহ বিভিন্ন এলাকায় তল্লাশী অভিযান পরিচালনা করে। এছাড়াও হেলিকপ্টারযোগে টহল পরিচালনা করে র‌্যাব। একপর্যায়ে র‌্যাবের গতিবিধি ও তৎপরতা আঁচ করতে পেরে গত ২৩ নভেম্বর ২০২১ তারিখ অপহৃতদের নৌকায় রেখে ডাকাতরা চলে যায়। অতঃপর কিছুক্ষণ পরে ভিকটিমদেরকে ডাকাত সন্দেহে ঘিরে ফেলে হামলা চালানো হয়। মূলত উক্ত ডাকাতরা অন্যান্যদের নৌকাকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে নিয়ে এসে এ হামলা চালিয়ে কৌশলে স্থান ত্যাগ করে বলে ভুক্তভোগীরা জানায়।

৪। এতদসংক্রান্ত বিষয়ে ইতোমধ্যে পাথরঘাটা থানায় ০২টি মামলা রুজ্জু হয়। মামলা নং ১৬ এবং ১৭ তারিখ ২৭ নভেম্বর ২০২১। ধারা ৩৯৫/৩৯৭/৩৬৫/৩৮৫/৩৮৬ পেনাল কোড।

৫। অপহৃতদের ছেড়ে দেওয়ার পরেও র‌্যাব জলদস্যুদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রেখে চলেছে। র‌্যাব মোবাইল ব্যাংকিং ট্রান্সফারের মাধ্যমে মুক্তিপণের অর্থ প্রবাহের উপর গোয়েন্দা নজরদারী অব্যাহত রাখে। র‌্যাব গোয়েন্দারা নারায়ণগঞ্জসহ আরো কয়েকটি স্থানে এ সংক্রান্ত ফুটপ্রিন্ট সনাক্ত করে। এরই ধারাবাহিকতায় গোপন সংবাদের ভিত্তিতে র‌্যাব গোয়েন্দা শাখা ও র‌্যাব-৮ এর অভিযানে গত ৩০ নভেম্বর ২০২১ তারিখ রাতে নারায়নগঞ্জের রূপগঞ্জ এলাকা হতে বঙ্গোপসাগরের সমুদ্রসীমায় জেলেদের নৌকায় ডাকাতির মূল মুক্তিপণ সংগ্রাহক মোঃ ইলিয়াস হোসেন মৃধা (২৮), পিতাঃ মোঃ দেলোয়ার হোসেন, গলাচিপা, পটুয়াখালী’কে মুক্তিপণের অর্থসহ গ্রেফতার করে। উদ্ধার করা হয় মুক্তিপণের পাঁচ লক্ষাধিক টাকা। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃত ইলিয়াস বর্ণিত ডাকাতির সাথে জড়িত থাকার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান করে। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট জলদস্যুদের সম্পর্কে তথ্য দেয়। ফলশ্রæতিতে র‌্যাব তথ্য যাচাই বাছাই ও গোয়েন্দা অনুসন্ধান বৃদ্ধি করে।

৬। এরই ধারাবাহিকতায় র‌্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র‌্যাব-৮ এর আভিযানে গত ভোর রাতে পটুয়াখালী জেলার গলাচিপা এলাকা হতে উক্ত জলদস্যু দলের মূল সমন্বয়কারী (১) মোঃ খলিল জমাদ্দার (৫০), পিতাঃ মৃত কদম আলী জমাদ্দার, তালতলী, বরগুনা (২) মোঃ মাহাতাব পেদা (৩৩), পিতাঃ মৃত জালাল পেদা, কলাপাড়া, পটুয়াখালী (৩) মোঃ জামাল আকন্দ (৩৬), পিতাঃ আব্দুল জলিল আকন্দ, কলাপাড়া, পটুয়াখালী (৪) মোঃ মাছুম @ মানছুর খলিফা (৪৬), পিতাঃ নওয়াব আলী খলিফা, কলাপাড়া, পটুয়াখালী (৫) মোঃ মিনাজ খাঁ, পিতাঃ সিদ্দিক খাঁ, গলাপিচা, পটুয়াখালীদের’কে গ্রেফতার করা হয়। অভিযানে গুলি বিনিময়ের ঘটনা ঘটে। ঘটনায় ডাকাত দলের কয়েকজন পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। উক্ত অভিযানে জব্দ হয় ৩টি অস্ত্র, গোলাবারুদ এবং ডাকাতিতে ব্যবহৃত নৌকা। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃতরা বর্ণিত ডাকাতির ঘটনার সাথে তাদের সংশ্লিষ্টতার তথ্য প্রদান করেছে।

৭। জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফাতারকৃতরা জানায়, গ্রেফতারকৃতরা বঙ্গোপসাগরের সংঘবদ্ধ জলদস্যু দলের সদস্য। উক্ত ডাকাত/জলদস্যু দলের সদস্য সংখ্যা প্রায় ১৭-১৮ জন। সর্দারের নেতৃত্বে বিগত ৩/৪ বছর পূর্বে দলটি সংঘবদ্ধ হয়। বিভিন্ন সময়ে তারা মাছ ধরার মৌসুমে সমুদ্রে জেলেদের অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবী ও মালামাল লুন্ঠন করে থাকে। তারা চট্টগ্রাম, স›দ্বীপ, কক্সবাজার ও ভোলাসহ পটুয়াখালী, বরগুনা ইত্যাদি এলাকার দূরবর্তী বঙ্গোপসাগরে জলদস্যুতা/সাগরে দস্যুতা করে থাকে।

৮। জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃতরা আরও জানায় যে, জলদস্যু এই দলের সদস্যরা কয়েকটি ভাগে ভাগ হয়ে ডাকাতি করে থাকে। একটি উপদল অস্ত্রসহ অপহরণ ও লুটতরাজে অংশগ্রহণ করে। এই উপদলে সাধারণত ৮-১০ জন সদস্য থাকে। সর্দার নিজেই সাধারণত সরাসরি এই উপদলের নেতৃত্ব দিয়ে থাকে। অপর ২/৩ জনের একটি উপদল, মূল দলের সহযোগী হিসেবে ডাকাতিকালীন সময়ে কাজ করে। যারা প্রয়োজন অনুযায়ী লুন্ঠিত মালামাল সাগর হতে উপক‚লে নিয়ে আসে। অতঃপর উপক‚লীয় অঞ্চলে অবস্থানরত পর্যবেক্ষণ ও সমন্বয়কারী দলের নিকট হস্তান্তর করে। তারা বিভিন্ন মৎসব্যবসায়ীদের নিকট লুণ্ঠিত মালামাল বিক্রি করে থাকে। এই উপদলটি ৩/৪ জনের সমন্বয়ে গঠিত। এরা সাগরে গমনাগমনকারী মৎসজীবিদের ব্যাপারে গোপন তথ্যও সংগ্রহ করে থাকে।
তাছাড়া সর্বক্ষনিক বিভিন্ন গ্রæপের ভিতর সমন্বয় করে। এছাড়া তারা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর গতিবিধি ও সংগঠিত ডাকাতির প্রতিক্রিয়া ও ভ‚ক্তভোগী পরিবার সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে। এছাড়া মুক্তিপণ সংগ্রহ করার জন্য ভিন্ন আরও একটি ২/৩ জনের উপদল নিয়োজিত থাকে। যারা ঢাকা, নারায়নগঞ্জ সহ দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় অবস্থান পরিবর্তন করে অবস্থান করে। মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে মুক্তিপণ সংগ্রহ করে থাকে।

৯। গ্রেফতারকৃতরা জানায় ঘটনার প্রায় ১০/১২ দিন পূর্বে গলাচিপা খেয়াঘাটে সর্দারসহ গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকজন ডাকাত সদস্য বর্ণিত ডাকাতির বিষয়টি চুড়ান্ত পরিকল্পনা করে। উক্ত সময়ে গ্রেফতারকৃত খলিল উপস্থিত ছিল। অতঃপর সকল ডাকাত সদস্যদের জানানো হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী গত ১৯ নভেম্বর ২০২১ তারিখ সকাল ১১০০ ঘটিকায় গলাচিপার একটি রাইস মিলের পাশে গ্রেফতারকৃত ও অন্যান্য সাগরে গমনকারী জলদস্যু সদস্যরা মিলিত হয়। অতপর পরিকল্পনামাফিক গলাচিপা খেয়াঘাট হতে একটি ভাড়াকৃত নৌকা যোগে গভীর সমুদ্রে বলেশ্বর-পায়রা মোহনা হতে ৩০ কি.মি. দক্ষিণে যেয়ে এক এক করে সর্বমোট ০৭ টি নৌকায় ডাকাতি করে এবং ০৭ জনকে অপহরণ করে জীম্মি করে। লুন্ঠিত মালামাল নিয়ে ভাড়াকৃত নৌকাযোগে প্রত্যাবর্তন করে গ্রেফতারকৃত খলিলের নিকট হস্তান্তর করে। গ্রেফতারকৃত খলিল উক্ত লুন্ঠিত মাছ মৎস ব্যবসায়ীর নিকট বিক্রি করে বলে জানায়।

১০। গ্রেফতারকৃতরা জানায়, অপহরণ করার পর মাঝিদের নৌকার পাটাতনের নীচে গাদাগাদি করে রেখে দেয়। অতঃপর তারা দক্ষিণ পূর্ব দিকে যাত্রা করে বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান করে। তারা সোনারচর-চর নিজাম-মনপুরা হয়ে স›দ্বীপ চ্যানেল এর কাছাকাছি পর্যন্ত গমন ও প্রত্যাবর্তন করে। গমনাগমন কালে দিনে নেটওয়ার্কের বাহিরে ও রাতে নেটওয়ার্কের ভিতরে অবস্থান করে সমন্বয় ও মুক্তিপন দাবী করে থাকত। এক পর্যায়ে তারা র‌্যাবের বিভিন্ন তল্লাশী অভিযান সম্পর্কে জানতে পেরে ভুক্তভোগীদের ছেড়ে দেয়। ভুক্তভোগীদের ছেড়ে দিয়ে কৌশলে ভুক্তভোগীদের ডাকাত বলে অপপ্রচার চালায়।

১১। গ্রেফতারকৃত খলিল উক্ত দলের মূল সমন্বয়কারীর দায়িত্ব পালন করে থাকে। সে তালতলী, আমতলী, পটুয়াখালীতে দোকান পরিচালনার ছদ্মবেশে ডাকাতি কার্যক্রমের সমন্বয়কের ভ‚মিকা পালন করে থাকে। সে ডাকাতি পরিকল্পনায় যুক্ত থাকে এবং গোপনে ডাকাত দলকে নানাবিধ সহযোগীতা করে থাকে। সে ডাকাত দলের লুন্ঠিত মাছ কয়েকজন সুবিধাবাদী মৎসব্যবসায়ীদের নিকট বিক্রির ব্যবস্থা করে। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে ডাকাতি শেষে ডাকাতিতে ব্যবহৃত অস্ত্রগুলো বিভিন্ন স্থানে লুকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করে। গ্রেফতাকৃত ডাকাত মাহাতাব পেদা, খলিল জমাদ্দার, জামাল আকন্দ মাছুম @ মানছুর খলিফা, মিনাজ খাঁ স্ব-শরীরে ডাকাতিতে অংশগ্রহণ করে ও ভিকটিমদের নির্যাতন করে। তন্মধ্যে গ্রেফতারকৃত জামাল স্ব-শরীরে ডাকাতিতে অংশগ্রহণ ছাড়াও সমুদ্রে দিক নির্নয়ে ও নৌকা চালানোর কাজ করে থাকে। গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে অন্যান্য সদস্যদের সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান করেছে।
গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।

এই বিভাগের আরও খবর


ফেসবুকে আমরা