April 23, 2024, 4:02 pm

বাবা দিবসে “”আমার বাবা”” অনুভূতি প্রকাশ করেছেন জুডি:ম্যাজি: ইয়াছমিন নাহার

বি এম বাবলুর রহমান- সাতক্ষীরা:জন্মের পরে যিনি আমাকে বৈষম্যহীনভাবে ভালোবেসেছে, তিনি আমার বাবা। আগে একটা মেয়ে থাকা সত্ত্বেও যিনি পরম যত্নে আমাকে বড় হওয়া অবধি দুই হাত দিয়ে কোলে তুলে নিয়েছেন তিনিই আমার বাবা। আমার কলিগ আমার জন্য যাঁর নিবেদিতপ্রাণ দেখে বলেছেন, ‘ইয়াসমিন! তুমি চাইলে তোমার বাবা হেলিকপ্টারও কিনে দেবে’, তিনিই আমার বাবা। দুই মেয়ের জনক হিসেবে যাকে অনেক অনেক কথা শুনতে হয়েছে, বলা হয়েছে বংশে বাতি দেওয়ার কেউ থাকলো না! তিনিই আমার পরম শ্রদ্ধার বাবা।

আমি জানি না বাবার মনে কি এক জেদ চেপে গিয়েছিল, আমার পড়ার জন্য এতো চাপ দিতেন মাঝে মাঝে আমি বিরক্ত হয়ে যেতাম। এমনকি কোন আত্নীয় স্বজন আমাদের বাড়ি আসলে আমার ঘরের দরজা বন্ধ করে দিতেন যেন আমার লেখাপড়ার কোন ক্ষতি না হয়। কোন কারণে স্কুলে না গেলে বাবা আমার সাথে কথা বন্ধ করে দিতেন। স্কুলে ভালো রেজাল্ট করলে যিনি আনন্দে টগবগ করতেন। আমার বাবা আমার টুকটাক লেখালেখির প্রথম উৎসাহদাতা, আগে ছোটদের পাতায় একটু আধটু লিখতাম আর পত্রিকার পাতায় কোন লেখা প্রকাশিত হলে আমার বাবার সেকি উল্লাস! সবাইকে ডেকে ডেকে দেখাতেন। লেখা পোস্ট করতে যেন কোন সমস্যা না হয় এজন্য অনেকগুলো খাম কিনে আমার ড্রয়ারে রেখে দিতেন। নিজে তেমন ডিগ্রীধারী না হলেও আমার জন্য বাংলা দৈনিকের পাশাপাশি ইংরেজি দৈনিক পত্রিকা রাখতেন। মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য কম্পিউটার সহজলভ্য হওয়া মাত্রই যিনি আমার জন্য কম্পিউটার কিনে দিয়েছিলেন যেন প্রযুক্তির জ্ঞানে আমি পিছিয়ে না থাকি। উৎসাহ দিতেন পড়ালেখার পাশাপাশি অন্যান্য কার্যক্রমে, আমি যখন কোন প্রতিযোগিতায় সনদপত্র পেতাম আমার বাবা কতবার যে সেটা দেখতেন, হাত দিয়ে ছুঁয়ে স্নেহের পরশ বুলাতেন।আমার স্কুল – কলেজে পড়াকালীন বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় প্রাপ্ত সব সনদপত্র আমার বাবা খুব যত্ন করে ফাইল বন্দী করে নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন। দলিল পত্র বের করার সময় সেগুলো বের করে দেখেন আর যত্ন করে আমার নামটি বার বার পড়েন!

আমার পড়ালেখার জন্য বাবা কত যে অনুপ্রেরণার উৎস তা একমাত্র আমিই জানি। ছোট্ট থেকে অনার্স পর্যন্ত প্রতি রাতে আমার বাবা আমার পড়াশোনার নিয়মিত খবর নিয়েছেন, নিয়মিত ক্লাস করছি কি না, ক্লাসে ঠিকমত অংশগ্রহণ করছি কি না, শিক্ষকদের সুনজর আছে কি না, উৎসাহ দিয়েছেন, অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। যখন কিন্ডারগার্টেন এ পড়ি আমার জন্য ক্লাসের সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতেন আমি বাবার চেহারা দেখে ভরসা পেতাম আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তিযুদ্ধেও বাবা আমার পাশে ছিলেন। আমার মনে আছে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য ২০০ কিঃমিঃ পথ আমার বাবা এই আমার জন্য দাঁড়ায়ে এসেছিলেন। বিয়ের পরে, চাকরি পাওয়ার পরে যখনই বলেছি, আমার সমস্যা হচ্ছে তা সে শারীরিক হোক বা কাজের লোক নিয়ে হোক, মুসকিল আসানের মত বাবা আমার মাকে নিয়ে হাজির হয়েছেন। গত বছর ২১ ফেব্রুয়ারির রাতে আমি হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পড়ি, ৮৫ কিঃমিঃ এর রাস্তা পেরিয়ে রাত ৩ টার সময় আমার বাবা হাজির।এখনো পর্যন্ত আমার ফোন রিসিভ করতে চান না, কল ব্যাক করবেন। কোনভাবে এই আর্থিক স্বাবলম্বী মেয়েকে একটু আর্থিক সহায়তা করতে পারলে সে যারপরনাই খুশি।আমার বাবা আমার মায়ের উপর ভীষণ নির্ভরশীল কিছুতেই কাছ ছাড়া করতে চান না কিন্তু আমার বিষয় আসলেই আমার বাবা নিজের খাবার- দাবার, সুখ – স্বাচ্ছন্দ্যের কথা ভুলে মাকে তৎক্ষণাৎ পাঠিয়ে দেন আমার কাছে।

সাত ভাই, দুই বোনের মাঝে আমার বাবা সবার বড়। বাবা যেন পরিবারের এক বিরাট বটবৃক্ষ যার ছায়ায় নিশ্চিন্তে বসতে পারে বাবার সব ভাই – বোনেরা। এমনকী যেকোন পরামর্শের জন্য বাবার চাচাতো ভাই, মামাতো ভাই, ফুফাতো ভাই সবাই এখনো আমার বাবার শরণাপন্ন হয়। আমার বাবার জীবনে আমি কিন্তু মোটেও সবচেয়ে গর্বের ব্যাপার নই বরং আমার বাবার সবচেয়ে গর্বের বিষয় হলো, তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। দেশের জন্য যুদ্ধ করেছেন, স্বাধীনতার জন্য লড়েছেন। আমার স্বল্পশিক্ষিত বাবা যখন মুক্তিযুদ্ধের উল্লেখ করেন তখন তাঁর চোখ -মুখ এক স্বর্গীয় আভায় উদ্ভাসিত হয়। নাতিদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের একই গল্প বার বারই করতে থাকেন কিন্তু তাঁর উৎসাহে একটুও ভাটা পড়ে না।

বাবা আমার এমনি একজন যাঁর হাত ধরে জীবন চলার বন্ধুর পথে হাঁটতে শিখেছি, যার অনুপ্রেরণা না থাকলে একাডেমিক পড়াশোনা আমার বুঝি শেষই করা হতো না, হতোদ্যম হয়ে মাঝ পথেই ছেড়ে দিতাম। আমার ক্যারিয়ারের শুরুতেই আমার বাবা বলেছিলেন, “কাজ যখন করবে ভালো করেই করবে আর না হলে করবে না”। বাবার এই কথা আমার সব সময়ের জন্য কর্মজীবনের মূলমন্ত্র। এখনো পাশে বসে না খাওয়ালে তাঁর ভালো লাগে না, মোবাইলে কিছুক্ষণ গল্প করতে না পারলে তাঁর স্বস্তি লাগে না। সাংসারিক, ব্যবসায়িক সব বিষয় আমাকে না জানালে তাঁর ভালোই লাগে না। সত্তরের কাছাকাছি থাকা চির তরুণ আমার বাবা এখনো সকাল নয়টা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত কাজের মাঝে ডুবে থাকেন। অপরের জন্য অকাতরে অর্থ ব্যয় করতে বিন্দুমাত্র কুন্ঠিত হন না যিনি, তিনিই আমার বাবা।

আমরা যারা মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান, তাঁদের জীবনে গল্প করার মত বেশি কিছু থাকে না কিন্তু একজন অনুপ্রেরণাদায়ী বাবা থাকে আর সেই বাবার থাকে দু’চোখ ভরা স্বপ্ন..

এই বিভাগের আরও খবর


ফেসবুকে আমরা