April 20, 2024, 8:55 am

ঘটনা ঘটলেই সরব… ? ভোলারাম বাঙ্গালী সব ভুলে যায়! ? এসব নিছক দুর্ঘটনা নাকি হত্যাকান্ড?

মীর আব্দুল আলীম:বাংলাদেশে একের পর এক ‘দুর্ঘটনা’য় মৃত্যু অবিরাম এবং অবাধ। আগুনে পুড়ে,
সড়ক-নৌ-রেল পথ, রাসায়নিক বিস্ফোরণে গৃহে, কর্মস্থলে নানা ভাবে এদেশে
অসংখ্য মানুষ হতাহত হয় প্রতি বছর। রানা প্লাজা ধ্বস, পুরান ঢাকার নীমতলী,
চুরিপট্রি ট্রজিডি, নৌ-রেল এবং সড়কে একের পর এক দুর্ঘটনায় জানমালের
ব্যপক ক্ষতি হচ্ছে। যখন বড় ধরনের কোন ঘটনা ঘটে তখন রাষ্ট্রের টনক নড়ে।
সরব হয় সবাই। ঘটনার ক’দিন বাদে আবার চুপসে যায়; ভোলারাম বাঙ্গালী সব ভুলে
যায়! ঘটনার পর সংশ্লিষ্ট দফতর তদন্তকমিটি করে; মামলা হয়। পরের খবর কি তা
কেউ রাখে না। দুর্ঘটনা রোধকল্পে কি ব্যবস্থা নেয়া হয়। বিচার হয় ক’টার?
বিচারহীনতায় যা হবার তাই হচ্ছে; হবেও।
এসব মৃত্যু কি নিছক দুর্ঘটনা নাকি চরম দায়িত্ব অবহেলা, অনিয়ম আর কাঠামোগত
হত্যাকান্ড? এ প্রশ্ন থেকেই যায় বারবার। রুটিন মাফিক তদন্ত কমিটির
প্রতিবেদনে দেখা যায় সব ঘটনায়ই অনিয়মের কারণে সংঘটিত হয়। তাহলে বিচার হয়
না কেন? প্রথাগত সংজ্ঞা অনুসারে দুর্ঘটনা হলো একটি অদৃষ্টপূর্ব, অকল্পনীয়
এবং আকস্মিক ঘটনা। কিন্তু নির্দিষ্ট কিছু ঘটনা যখন একইরকম কারণে বার বার
ঘটতে থাকে, যে কারণগুলো ব্যবস্থা বা কাঠামোর সাথে সংযুক্ত, তখন সেগুলো
আর আকস্মিক বা অদৃষ্টপূর্ব থাকেনা, ফলে সেগুলো আর সাধারণ দুর্ঘটনা
থাকেনা, হয়ে উঠে ব্যবস্থাপনাগত বা কাঠামোগত অবহেলার ফল। এভাবেইতো চলতে
থাকে। চলছে এদেশ সৃষ্টির পর থেকে।
কোন ঘটনা ঘটলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আবার তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশিত হয় কম।
হলেও তদন্ত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন হয় না। ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার কারণে
মৃত্যু কিংবা সম্পদহানির ক্ষেত্রে কোনোই ক্ষতিপূরণও দিতে হয়না, জবাবদিহিও
করতে হয় না। যখন ঘটনা ঘটে তখন কয়েক হাজার টাকা স্বজনদের হাতে গুজে দিতে
দেখা যায় কখনো কখনো। বিচর কি হয়? চুড়ান্ত প্রতিবেদন প্রওকাশের পর কিংবা
তদন্তে দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া
হয়না বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। এসবে দায়দায়িত্ব নেবার প্রক্রিয়াও দেখা যায় না
কখনো। তাই যা হবার তাই হয়। একইরকম কারণ বিদ্যমান থাকায় একই ধরনের
দুর্ঘটনা বারে বারে এবং আরও ভয়ংকরভাবে পূনরাবৃত্তি হয়।
রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি:
পাঠক নিশ্চয় বিশ্বের শিল্প দুর্ঘটনার ইতিহাসে অন্যতম আলোচিত সাভারের
রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি কথা ভুলেনি আপনারা? বাংলাদেশ তো বটেই গোটা দেশ
বিশ্বকে নাড়িয়ে দেয়। দেশের ইতিহাসে কঠিন এ ট্র্যাজেডি ঘটে ২০১৩ সালের ২৪
এপ্রিল। এই দিনে সাড়ে ৩ হাজার শ্রমিকভর্তি আট তলা ভবন ধসে নিহত হন ১
হাজার ১৩৮ জন। আহত হন আরো প্রায় ২ হাজার। আট বছর পার হলেও এ ঘটনায়
দায়ীদের এখনো বিচার হয়নি। ঐ সময়ে ভবনের মালিক রানাসহ কারখানার মালিকরা
গ্রেফতার হলেও একমাত্র রানা ছাড়া বাকিরা জামিনে বেরিয়ে এসেছেন। রানা
প্লাজা ধসের পর আট বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও দায়ীদের বিচারে কেন অগ্রগতি
নেই। এ ঘটনায় হওয়া মূল মামলায় পাঁচ বছর আগে বিচার শুরু হলেও এখনও কোনো
সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি। রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় এ পর্যন্ত ভবনের মালিক রানা,
তার পরিবার, সাভার পৌরসভার তৎকালীন মেয়রসহ বিভিন্ন জনের নামে পাঁচটি
মামলা হয়। এর মধ্যে পুলিশ বাদী হয়ে একটি, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ
(রাজউক) একটি এবং দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তিনটি মামলা দায়ের করে।
সম্পদের হিসাব দাখিল না করা সংক্রান্ত নন সাবমিশন মামলায় রানার তিন বছর
কারাদণ্ড হয়েছে ২০১৭ সালের ২৯ আগস্ট। এ মামলায় তাকে ৫০ হাজার টাকা
জরিমানা অনাদায়ে আরও তিন মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। দুদকের মামলায় বিচার
হলেও ভবন ধসের ঘটনায় মূল মামলার বিচারে অগ্রগতি নেই। এ ঘটনায় হওয়া দুটি
মামলাতেই পাঁচ বছর আগে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরু হয়। তবে উচ্চ
আদালতে স্থগিতাদেশের কারণে এ মামলায় দীর্ঘ এ সময়েও কোনো সাক্ষ্যগ্রহণ
হয়নি। নেই বিচারের আর কোন অগ্রগতি। বিচারহীনতার কারনে এদেশে আরও বহু ভবন
ভবন নিয়মনীতি ছাড়াই গড়ে উঠেছে। ঘটেছে দুর্ঘটনাও। এ দ্বায় কাদের?
অব্যহত অগ্নিকাণ্ডে মৃতু:
বাংলাদেশে প্রতিবছর অসংখ্য অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। পুরান ঢাকার নীমতলী
ট্রাজেডি, চুরিপট্রি ট্রাজেডি, আশুলীয়ার তাজরীন গার্মেন্টসের অগ্নিকাণ্ড,
ইসলামবাগের জুতা ফ্যাক্টরীসহ নানা প্রতিষ্টানে ২০০৯ থেকে ২০২০ সাল এই ১২
বছরে দেশে ছোট-বড় অন্তত ২ লক্ষ ২ হাজার ১৯টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে
যেসব ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ১ হাজার ৯৭৪ জন। বড় ঘটনা গুলোর মধ্যে- ২০১০
সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলীতে কেমিকেল গোডাউনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১২৩
জনের প্রাণহানি ঘটে। ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর সাভারের আশুলিয়ায় তাজরীন
ফ্যাশনসে আগুন লেগে নিহত হয় ১১১ জন শ্রমিক।২০১৩ সালের ২৯ জুলাই
ইসলামবাগের হাজী মুরাদ হোসেনের ‘শিকদার প্লাস্টিক’ নামের জুতার সোল তৈরির
কারখানায় আগুন লেগে ঘটনাস্থলেই নিহত হন ১১ শ্রমিক, আহত হয়ে ঢাকা
মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে ভর্তি হন আরো ৭ জন শ্রমিক।২০১৩ সালের ০৮ অক্টোবর
গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলায় পলমল গ্রুপের আসওয়াদ কম্পোজিট মিলস লিমিটেড
নামের একটি পোশাক কারখানায় আগুন লেগে কমপক্ষে নয়জন নিহত হন।২০১৬ সালের ২২
নভেম্বর ঢাকার আশুলিয়ায় কালার ম্যাক্স (বিডি) লিমিটেড নামের গ্যাস লাইটার
তৈরির কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ২৬ জন নারী ও শিশু শ্রমিক দগ্ধ হয় যার মধ্যে
পাঁচজন মারা যায়।২০১৯ সালের ২৮ মার্চ বনানীর এফআর টাওয়ারে আগুন লেগে
ধোঁয়ায়, লাফিয়ে পড়ে, পুড়ে ২৭ জন নিহত ও অন্তত ৭৫ জন আহত হন। ২০১৯ সালের
২০ ফেব্রুয়ারি রাতে পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় হাজী ওয়াহেদ
ম্যানশনের পারফিউম কারখানা ও কেমিকেলের গোডাউন থেকে ভয়াবহ বিস্ম্ফোরণ ও
অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারান ৭১ জন। ২০১৬ সালের ২৩ জানুয়ারি গাজীপুরের
পুবাইলের ‘স্মার্ট মেটাল অ্যান্ড কেমিক্যাল’ কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণে
সাতজনের প্রাণহানির ঘটে। ২০১৭ সালের ১৯ এপ্রিল দিনাজপুর শহরের রানীগঞ্জ
এলাকার যমুনা অটো রাইস মিলে বয়লার বিস্ফোরণে ১৯ জন নিহত হন। এই ঘটনার
কিছুদিন পরেই ২০১৭ সালের ৩ জুলাই গাজীপুরের কাশিমপুরে মাল্টি ফ্যাবস
নামের পোশাক কারখানার বয়লার বিস্ফোরণে ১৩ জন নিহত হন। এরকম বড় ঘটনা ছাড়াও
ছোট ছোট দুর্ঘটনায় কখনো চাল কলে কখনো পোষাক কারখানায় বা অন্য কোনো
করখানায় নিয়মিত বয়লার বিস্ফোরণে প্রাণহানির ঘটনা ঘটে থাকে। ফায়ার সার্ভিস
ও সিভিল ডিফেন্সের তথ্য অনুসারে সর্বশেষ ২০১৯ সালে বয়লারে ১১টি
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ১৫ জন নিহত ও ১০ জন আহত হয়েছেন।
যথাযথ অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায় এবং ত্রুটিপূর্ণ অবকাঠামোর কারনে
এসব অগ্নিকাণ্ড সময় মতো নিয়ন্ত্রণ করা যায় না, বহু মানুষ হতাহত হয় এবং
সম্পদ নষ্ট নয়। বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের
পরিসংখ্যান অনুসারে ২০০৯ থেকে ২০১৯ সাল এই ১১ বছরে দেশে ছোট-বড় অন্তত ১
লক্ষ ৯২ হাজার ৯২টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে যেসব ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন
১ হাজার ৬৭৪ জন। ফায়ার সার্ভিসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৯ সালে সারা
দেশে ১২ হাজার ১৮২টি অগ্নিকাণ্ডে ১১৮ জন নিহত ও ১ হাজার ৮৭ জন আহত হন।
২০১০ সালে ১৪ হাজার ৬৮২টি অগ্নিকাণ্ডে ২৭১ জন নিহত ও ৭১৯ জন আহত হন। ২০১১
সালে ১৫ হাজার ৮১৫টি দুর্ঘটনায় ৩৬৫ জন নিহত ও ১ হাজার ৩৮৫ জন আহত হন।
একইভাবে ২০১২ সালে ২১০ জন নিহত ও ৭৫৯ জন আহত, ২০১৩ সালে ১৬১ জন নিহত ও ১
হাজার ৩৮৫ জন আহত, ২০১৪ সালে ৭০ জন নিহত ও ২১০ জন আহত, ২০১৫ সালে ৬৮ জন
নিহত ও ২১৬ জন আহত, ২০১৬ সালে ৫২ জন নিহত ও ২৪৭ জন আহত, ২০১৭ সালে ৪৫ জন
নিহত ও ২৬৯ জন আহত, ২০১৮ সালে ১৩০ জন নিহত ও ৬৬৪ জন আহত এবং ২০১৯ সালে ২৪
হাজার ৭৪টি অগ্নিকাণ্ডে ১৮৪ জন নিহত ও ৫৬০ জন আহত হন। লক্ষণীয় যে ২০১৯
সালে ২০০৯ সালের তুলনায় দ্বিগুন অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।৬১অগ্নিকাণ্ডের
সূত্রপাত সম্পর্কে ফায়ার সার্ভিসের তদন্তে দেখা গেছে, বৈদ্যুতিক গোলযোগের
কারণেই বেশি অগ্নিকাণ্ড ঘটে। ২০১৯ সালের ২৪ হাজার ৭৪টি অগ্নিকাণ্ডের
মধ্যে ৮ হাজার ৬৪৪টি(৩৯ শতাংশ) অগ্নিকাণ্ডই ঘটেছে বৈদ্যুতিক গোলযোগের
কারণে। চুলার আগুন থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে ৪ হাজার ৪২৮টি(১৮ শতাংশ),
আর সিগারেটের আগুন থেকে ৪ হাজার ১৫৩টি(১৫ শতাংশ)।
সড়ক মৃত্যু :
সড়ক মহাসড়কে মানুষের নিয়মিত মৃত্যু এখন “স্বাভাবিক” ঘটনায় পরিণত হয়েছে।
প্রতিদিন আমরা সড়ক মহাসড়কে বহু মানুষের আহত-নিহত হওয়ার খবর শুনি এবং
তারপর ভুলে যাই। কোন বড় ঘটনায় আন্দোলন হলে নয়া আইন হয়। কার্য্যকর হয় না।
ছাত্র আন্দোলনের পর সর্বশেষ যে আইন হয়েছে। তা পরিবহন শ্রমিকদেও চাপের
মুলে পরিবর্তন করতে হয়েছে হালে। আইনের প্রয়োগ না হলে সড়ক মৃত্যু থামবে
কি করে? আমরা জানতে পারি ২০২০ সালে যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসেবে সড়ক
দুঘটনায় নিহত হয়েছে ৭ হাজার ৮৫৫ জন এবং নিরাপদ সড়ক চাই(নিসচা) এর হিসেবে
৫ হাজার ২২৭ জন। সড়ক মহাসড়কে অকালে আহত/নিহত হওয়া এই মানুষগুলো শুধুই
সংখ্যা হয়ে যায়- পরিসংখ্যানের আড়ালে হারিয়ে যায় এক একজন রক্ত মাংসের
মানুষের স্বপ্ন কল্পনা, এক একটি পরিবারের আশা আকাঙ্খা।
বাংলাদেশের সড়ক মহাসড়কে প্রতিদিন নিয়মিতভাবে যেসব ঘটনায় বহু মানুষ আহত
নিহত হচ্ছেন সেসব ঘটনা বিভিন্ন ব্যক্তির খেয়ালখুশির কারণে ঘটছে নাকি
যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থার কাঠামোর ধরণ ও তার বিভিন্ন অন্তর্গত সমস্যার
কারণেই ঘটছে তার বিশ্লেষণ করলেই স্পষ্ট হয়ে যাবে এসব ঘটনাকে নিছক
দুর্ঘটনা বলা যাবে কিনা। সড়ক পথে নিরাপদ যাতায়াত ও পরিবহন ব্যবস্থার
অপরিহার্য উপাদান হলো: ত্রুটিমুক্ত যথাযথ ডিজাইনের সড়ক মহাসড়ক,
ত্রুটিমুক্ত যানবাহন, লাইসেন্সধারী দক্ষ চালক, চালক ও হেলপারদের যথাযথ
মজুরি ও কর্মপরিবেশ, পরিবহন মালিক ও পরিবহন কোম্পানিগুলোকে আইন মানতে
বাধ্য করতে সক্ষম নিয়ন্ত্রক সংস্থা ইত্যাদি। এর কোনো একটির অনুপস্থিতিতেই
যাতায়াত ও পরিবহন ব্যবস্থা অনিরাপদ হয়ে উঠতে বাধ্য।
অনিরাপদ নৌ পথে:
বাংলাদেশ সরকারের নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের দেয়া তথ্য অনুসারে বাংলাদেশে ১৯৯১
থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৬৩৮টি নৌ দুর্ঘটনা ঘটে যেসব দুর্ঘটনায় মারা যান
সাওে ৩ হাজার মানুষ। এদের মধ্যে লঞ্চের যাত্রী এক হাজার ৭৮১ জন। আর
বেসরকারি সংগঠন নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী
১৯৯৬ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ২০ বছরে ছোট-বড় মিলিয়ে ৬৫৩টি লঞ্চ
দুর্ঘটনা ঘটেছে যেসব দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ৬,৪০৮। অন্যদিকে নদী
নিরাপত্তা বিষয়ক সামাজিক সংগঠন নোঙরের হিসাব অনুযায়ী ২০০৫ থেকে ২০১৯ এই
১৪ বছরে ৫৩৫টি বড় নৌ দুর্ঘটনায় ৬ হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে আর
এসব দুর্ঘটনা তদন্তে ৮৬৩টি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এসব তদন্ত কমিটির খুব কম
রিপোর্টই আলোর মুখ দেখেছে। এর মধ্যে একটি ব্যতিক্রম হলো এমভি বিপাশা নামক
লঞ্চ দুর্ঘটনার তদন্ত রিপোর্ট। ২০১১ সালের ২১ এপ্রিল
ভৈরব-সাচনা-সুনামগঞ্জ রুটে চলাচলরত এমভি বিপাশা নামক একটি লঞ্চ ভৈরব হতে
যাত্রী ও মালামাল নিয়ে সাচনা যাবার পথে মেঘনা নদীতে অন্য একটি নিমজ্জিত
কার্গো জাহাজের সাথে ধাক্কা লেগে ডুবে যায়, প্রাণ যায় ২৮ জন যাত্রীর। এই
দুর্ঘটনার তদন্ত রিপোর্টটি বিআইডব্লিউটিএর ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়।
রিপোর্টটিতে এমভি বিপাশা লঞ্চ দুর্ঘটনার কারণ যেমন তুলে ধরা হয়, তেমনি
ভবিষ্যতে এ ধরণের দুর্ঘটনা যেন না ঘটে সে জন্য অনেকগুলো সুপারিশও করা হয়।
নৌ পথে দুর্ঘটনার পেছনে কাঠামোগত অব্যবস্থাপনা কতটা দায়ী তা বোঝার জন্য
এই রিপোর্টে উল্লেখকৃত দুর্ঘটনার কারণগুলো খতিয়ে দেখা দরকার।
বাংলাদেশের নৌপথে যত দুর্ঘটনা ঘটে তার দুই তৃতীয়াংশই দুটো নৌযানের
মধ্যে সংঘর্ষ এবং অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাইয়ের কারণে ঘটে। এই বেশিরভাগ
সংঘর্ষই ঘটে রাতে বা শীতকালে কুয়াশার মধ্যে যখন দৃষ্টিসীমা থাকে সীমিত।
সড়ক বা রেলপথের চেয়ে অপেক্ষাকৃত প্রশস্ত নেভিগেশন চ্যানেলের নদী পথে
নৌযানগুলোর পরস্পরের সাথে সংঘর্ষের বিষয়টি এমনিতে খুব অস্বাভাবিক। কিন্তু
নদী শুকিয়ে নাব্যতা কমে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে রাত্রিকালীন নৌ চলাচলের জন্য
যদি নৌ-রুটে রাত্রিকালীন নৌ-চলাচল সহায়ক যন্ত্রপাতি না থাকে, যদি নৌপথে
স্থানে স্থানে অচিহ্নিত ডুবোচর থাকে কিংবা নৌযানগুলোতে যদি রাতে এবং
কুয়াশার মধ্েয চলাচলের জন্য অত্যাবশ্যকীয় সরঞ্জাম না থাকে তাহলে এই
অস্বাভাবিক ব্যাপারটিই স্বাভাবিক ও নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়।
আগস্টের ৪ তারিখ ভুলে যাওয়ার মতো কোন দিন না। প্রতি বছর দিনটি এলেই মনে
পড়ে যায় পিনাক-৬ লঞ্চডুবির সেই ঘটনা। ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী
বহণকারী পিনাক-৬ সেদিন প্রবল স্রোতের কবলে পড়ে যায় পদ্মার বুকে, মাওয়া
ঘাটের কাছে এসে ডুবে যায়। ২০১৪ সালের আগস্টের শুরু থেকেই পদ্মা ছিল
উত্তাল, ঘোষণা করা হয়েছিলো ২ নম্বর সতর্ক সংকেতও। নিয়মানুযায়ী,
এমতাবস্থায় ৬৫ ফুটের কম দৈর্ঘ্যের লঞ্চ চলাচল করা নিষিদ্ধ থাকলেও, সমস্ত
বিধি-নিষেধ অমান্য করে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত ৪ থেকে ৫ গুণ যাত্রী নিয়ে
রওনা করে ৫২ ফুট (সাড়ে ১৯ মিটার) দৈর্ঘ্যের পিনাক-৬। উদ্ধার হয় ৪৯ জনের
লাশ, বেওয়ারিশ হিসেবে শিবচরে দাফন করা হয় ২১ জনের মৃতদেহ। এছাড়াও সরকারি
হিসেবেই নিখোঁজ থাকে ৬১ যাত্রী। সেদিন হত, আহত ও নিখোঁজ ব্যক্তিদের
পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনের গগণবিদারী চিৎকারে ভারি হয়ে ওঠে পদ্মার পার।
সেটা যেন হয়ে উঠেছিল এক মৃত্যুপুরী! জানা গিয়েছিল, ‘১৯৯১ সালে তৈরি হওয়া
পিনাক-৬ লঞ্চে ছিল না যাত্রীদের আত্মরক্ষার জন্য কোন সেফটি ইকুইপমেন্ট,
এমনকি চালকের লাইসেন্স পর্যন্ত ছিল না।’বিআইডব্লিউটিএ, সমুদ্র অধিদপ্তর,
লঞ্চের মালিক, ঘাটের ইজারাদার হয়ে ঘুরতে ঘুরতে সবশেষে মামলাটিই বরফ ঘরে
লুকায়। এভাবে সকল লঞ্চ দুর্ঘটনার পর তদন্ত কমিটি, কদিন হৈ চৈ তারপর সব
ধামাচাপা পরে।
অনিরাপদ রেল যোগাযোগ :
সারা দুনিয়াতেই রেল নিরাপদতম যাতায়াত মাধ্যম হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশের
রেলপথ সড়ক বা নৌ পথের তুলনায় নিরাপদ হলেও রেলপথে জীবন ও সম্পদহানিকর
দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে প্রতিনিয়ত। গণমাধ্যমকর্মীদের সংগঠন শিপিং অ্যান্ড
কমিউনিকেশন রিপোর্টার্স ফোরামের (এসসিআরএফ) ‘রেলপথে দুর্ঘটনার বার্ষিক
প্রতিবেদন-২০১৯’ অনুসারে, ২০১৯ সালে ৩৯৩টি রেল দুর্ঘটনায় ৮৯ নারী ও ৪৬
শিশুসহ ৪২১ জন নিহত এবং চার নারী ও ৩৩ শিশুসহ ৩৬৬ জন আহত হয়েছে। আর
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসেব অনুসারে ২০১৯ সালে রেলপথে ৪৮২টি
দুর্ঘটনায় ৪৬৯ জন নিহত ও ৭০৬ জন আহত হয়েছে। বাংলাদেশে রেল দুর্ঘটনার
মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘটে ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে আর সবেচেয়ে বেশি মানুষ মারা
যায় অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ে ট্রেনের সঙ্গে অন্যান্য যানবাহনের সংঘর্ষে।
বাংলাদেশ রেলওয়ে ইনফরমেশান বুক ২০২০ থেকে দেখা যায়, ২০০৮-০৯ থেকে ২০১৯-২০
এই ১২ বছরে মোট ২ হাজার ৯২৮টি দুর্ঘটনা ঘটেছে যার মধ্যে লাইনচ্যুত হয়ে
দুর্ঘটনা ২ হাজার ৮৫৫ টি যা মোট দুর্ঘটনার ৮৯ শতাংশ। আর ট্রেন লাইন চ্যুত
হয়ে দুর্ঘটনার পেছনে যেসব কারণ দায়ী তার মধ্যে রয়েছে ত্রুটিপূর্ণ রেলপথ,
ইঞ্জিন বা বগির যান্ত্রিক সমস্যা, সিগনাল ব্যবস্থার সমস্যা, বিভিন্ন
ধরণের মানবীয় ভুল ও নিয়ম অমান্য করা ইত্যাদি। প্রতিনিয়ত রেল দুর্ঘটনা
ঘটছে কিন্তা কোনই প্রতিকার হচ্ছে না।
প্রশ্ন হলো এভাবে কি চলতেই থাকবে। মৃত্যুও মিছিলে যাত্রী বাড়তেই থাকবে।
নাকি এর কোন প্রতিকার হবে। নাগরিকের জীবন নিয়ে এই ধরণের অবহেলার পেছনে
সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের জনগণের কাছে জবাবদিহিতার কোনো ব্যবস্থানা না
থাকার পাশাপাশি দুর্নীতি ও অবৈধ অর্থ উপার্জনের প্রণোদনাও দায়ী। টিআইবি
এ তথ্য অনুসারে, নিয়ম লঙ্ঘন করে পুরান ঢাকায় রাসায়নিকের ব্যবসা চালিয়ে
নিতে ৩০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ আড়াই লাখ টাকা ঘুষ লেনদেন হয়। আনুষ্ঠানিক
ভাবে রাসায়নিকের গুদাম ও কারখানা স্থাপনে লাইসেন্স প্রদান বা নবায়ন বন্ধ
থাকলেও অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে এবং রাজনৈতিক প্রভাব কাজে
লাগিয়ে লাইসেন্স বের করার প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে
সিটি করপোরেশনের অসাধু কর্মকর্তাদের পরামর্শে ব্যবসায়ীরা তাঁদের
প্রতিষ্ঠানের নাম থেকে রাসায়নিক শব্দটি বাদ দিয়ে এন্টারপ্রাইজ হিসেবে
ট্রেড লাইসেন্স বের করে নেয়। লাইসেন্স বের করা কঠিন হয়ে পড়লে রাজনৈতিক
নেতাদের প্রভাব ব্যবহার করা হচ্ছে। কোন সড়ক দুর্ঘটনা ঘটলে পথেই পুলিশ,
রাজনৈতিক কিংবা প্রভাবশালীদেও নিয়ন্ত্রনে মিমাংসা হয়। নৌ, সড়ক,
অগ্নিকান্ডের ঘটনায় তদন্ত কমিটি হয়। পরে নাকি বড় লেনদেনে আপোষরফাও হয়।
তাইতো একের পর এক এই ঘটনায় মৃত্যুও সংখা বাড়ে। যেকোন মূল্যে এসব মৃত্যু
রোধ করতে হবে। এ জন্য সরকার এবং সংশ্লিষ্টদের এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক- মীর আব্দুল আলীম, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

এই বিভাগের আরও খবর


ফেসবুকে আমরা