April 19, 2024, 4:57 pm

আসলে এটা কোন সমাজ? ? কঠিন শাস্তি হলেই ধর্ষণ কমে আসবে ? বিচারহীনতায় ধর্ষণ বাড়ছে

মীর আব্দুল আলীম :এদেশে ধর্ষিতারা বিচার পায়না; সমাজচ্যুত হয়। বিচারহীনতায় দিনদিন ধর্ষণের
ঘটনা বাড়ছেই। ১ মার্চে দৈনিক ইত্তেফাকের শীরোণাম- ফেনীতে ধর্ষণের শিকার
কিশোরীর পরিবার সমাজচ্যুত”। সংবাদে বলা হয়েছে, এক পুলিশ সদস্য ধর্ষণ
করেছিল ফেনীর ফুলগাজীর এক কিশোরীকে। নবম শ্রেণির ঐ ছাত্রী সন্তান জন্ম
দিলে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি (২০২১) এক সালিশ বৈঠকে ধর্ষণের বিচার না করে উলটো
কিশোরীর পরিবারকে সমাজচ্যুত করে। এদেশে এমন ঘটনা নতুন নয় অহড়হই ঘটছে। কতক
সংবাদপত্রে জায়গা পায় আবার বাকি সবঘটনা আড়ালেই থেকে যায়। অধিকাংশ ঘটনায়ই
সমাজের বিচারপতিরা অপরাধীর পক্ষ নেয়, উল্টো ভিক্টিমকে ফাঁসিয়ে দেয়। আসলে
এটা কোন সমাজ?
ধর্ষণ! ধর্ষণের পর খুন! দিনের পর দিন আমাদের দেশে এ জাতিয় যৌন অপরাধের
মাত্রা বেড়েই চলছে। এটি নতুন কোন বিষয় তা নয়; বলা যায় আমাদের সমাজ
বাস্তবতার এক করুণ চিত্র। খুন, ধর্ষণ আজকাল এই আধুনিক পৃথিবীর
নিত্যনৈমেত্তিক ঘটনা হলেও আমাদের দেশে এর মাত্রা যেন সব বিচিত্রতার সীমা
ছাড়িয়ে যাচ্ছে। কিছু মানুষরূপী নরপশু সভ্যতার ভাবধারাকে পাল্টে দিতে
হাযেনার নখ মেলে বসেছে। ধর্ষণের ক্ষেত্রে থাকছে না বয়স, স্থান, কাল,
পাত্রের ভেদ। অপসংস্কৃতি আর ভিনদেশি সংস্কিৃতির আগ্রাসন আমাদের সমাজকে
কতটা ক্ষতি করছে তা হালআমলের ধর্ষণের চিত্র দেখলেই বেশ টের পাওয়া যায়।
দেশব্যাপী শুরু হয়েছে ব্যভিচারের চূড়ান্তথপ্রকাশ্য ধর্ষণকামিতা।
রাত-বিরাতে নয় শুধু, দিনদুপুরে প্রকাশ্য ধর্ষণের ঘটনাও ঘটছে। শুধু ধর্ষণই
নয়, রীতিমতো গণধর্ষণ হচ্ছে। বাসের ভেতরে ধর্ষিত হচ্ছে মেয়েরা (২৪
জানুয়ারি মানিকগঞ্জে যা ঘটেছে), শিক্ষাঙ্গনে যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে
শিক্ষার্থীরা, এমপির কথিত এপিএসর দ্বারাও এদেশে ধর্ষিত হচ্ছে যুবতী। এই
হলো বাস্তবতা। শুধু ধর্ষণই নয়, দেশে ধর্ষণের পর নৃশংস হত্যার ঘটনা ঘটছে
অহরহ। অপরাধীর সাজা না হলে এ জাতীয় অপরাধ বাড়বে, এটি চির অবধারিত। এ
ধর্ষণ শুধু নারীর বিরুদ্ধে নয়, মানবতার বিরুদ্ধে চরম অপরাধ। বিশ্বের যেসব
দেশে ধর্ষণ বাড়ছে, দেখা যাচ্ছে ধর্ষণকারীর সাজা না হওয়া তার অন্যতম
প্রধান কারণ। এশিয়ার মধ্যে ভারত ও বাংলাদেশে ধর্ষণের অপরাধ বেশি হয়ে
থাকে।
পাঠক নিশ্চই মনে আছে ১৯৯৫ সালের বহুল আলোচিত ইয়াসমিন ধর্ষণ হত্যার মধ্য
দিয়ে এমন একটি অসহনীয় পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল। এরপর মধুপুরে কিশোরী
ধর্ষণ ঘটনা বিশেষভাবে আলোচনায় আসে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান
বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক চন্দন কুমার পোদ্দার তার বাসার কাজের মেয়ে শুক্ল
দে (১৫) কে অনেকদিন থেকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে আসছিল। লোকলজ্জার ভয়ে
ধর্ষণের ঘটনা কাউকে বলেনি কাজের মেয়ে শুক্লা। কিন্তু দিনের পর দিন যৌন
নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে ২৫ জানুয়ারি কাজের মেয়ে শুক্লা ধর্ষকের
স্ত্রীকে তার স্বামীর ধর্ষণের ঘটনা জানান। এরপর ধর্ষকের স্ত্রী ও কাজের
মেয়ে ঐ দিন থানায় অভিযোগ করেন। অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ ধর্ষক চন্দন
কুমার পোদ্দারকে চট্টগ্রামের লালখান বাজার এলাকার হাইলেভেল রোডের বাসা
থেকে আটক করে। গাজীপুর-৪ কাপাসিয়া আসনের সংসদ সদস্য সিমিন হোসেন রিমির
কথিত এপিএস কাজল মোল্লা কিশোরী গৃহকর্মীকে ধর্ষণ ও তার স্ত্রীর অমানুষিক
নির্যাতনের ঘটনায় উপজেলাজুড়ে তোলপাড়ের সৃষ্টি হয়েছে। গৃহকর্মীকে ধর্ষণ ও
নির্যাতনের লোমহর্ষক ঘটনা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হলে দেশজুড়ে সমালোচনার ঝড়
ওঠেছে। প্রতিনিয়ত এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান
অনুযায়ী বিগত ২০১২ সালে কমপক্ষে ১ হাজার ৮টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে যার মধ্যে
৯৮ জনকে ধর্ষণের পর খুন করা হয়। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের বার্ষিক
প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১১ সালে ৮০০-এর বেশি ধর্ষণ, ১৬৫টি গণধর্ষণ এবং ১৬টি
ধর্ষণের পর খুনের ঘটনা ঘটে। হাল সময়ে বহুল আলোচিত ধর্ষণের মধ্যে
টাঙ্গাইলের মধুপুরে এক কিশোরীকে তিনদিন আটকে রেখে গণধর্ষণ, সাভারের এক
কিশোরীকে ধর্ষণের পর ভিডিও প্রকাশের হুমকি, রাঙামাটির আদিবাসী কিশোরী,
ফরিদপুর ও কঙ্বাজারের স্কুলছাত্রী এবং ঢাকায় ৯ বছরের শিশুকে ধর্ষণের পর
হত্যার ঘটনাগুলো খুবই বেদনাদায়ক।
১৯৯৫ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ বিশেষ বিধান আইন করা হয়।
পর্যায়ক্রমে ২০০০ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন করা হয়। ২০০৩ সালে এ
আইন আবার সংশোধন করা হয়। ধর্ষণের শাস্তি কত ভয়ানক, তা অনেকেই জানেন না।
নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের ৯ ধারায় ধর্ষণের বিচার হয়। এ আইনে ধর্ষণের
সর্বনিম্ন শাস্তি পাঁচ বছরের কারাদ- এবং সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- করা
হয়েছে। আইনের ৯(১) ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো পুরুষ কোনো নারী বা শিশুকে
ধর্ষণ করে, তাহলে সে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে। এ ছাড়া
অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবে। ৯(২) উপধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি কর্তৃক
ধর্ষণ বা ওই ধর্ষণ-পরবর্তী তার অন্যবিধ কার্যকলাপের ফলে ধর্ষিত নারী বা
শিশুর মৃত্যু ঘটে, তাহলে ওই ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম
কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে। অতিরিক্ত এক লাখ টাকা অর্থদণ্ডেও দণ্ডিয় হবে।
উপধারা ৯(৩)-এ বলা হয়েছে, যদি একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোনো নারী বা
শিশুকে ধর্ষণ করে এবং ধর্ষণের ফলে ওই নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে বা তিনি
আহত হন, তাহলে ওই দলের প্রত্যেক ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হবে, যদি
কোনো ব্যক্তি কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে মৃত্যু ঘটানোর বা আহত করার
চেষ্টা করে, তাহলে ওই ব্যক্তি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে ও এর
অতিরিক্ত অর্থদ- হবে। ধর্ষণের চেষ্টা করলে ওই ব্যক্তি সর্বোচ্চ ১০ বছর ও
সর্বনিম্ন পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে । এ ছাড়া অতিরিক্ত
অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবে। এদেশে ধর্ষণের পাকাপোক্ত আইন আছে ঠিকই কিন্তু
আইনকে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। আইনের যারা প্রয়োগ করবেন তারা ঐ আইনের পথে
হাঁটেন না। মামলার চার্জশিট গঠনের সময় ফাঁক-ফোকর থেকে যায়। তাই শেষে রায়ে
ধর্ষিত কিংবা নির্যাতনের শিকার লোকজন সঠিক বিচার থেকে বঞ্চিত হন। ধর্ষণ
যেহেতু মস্ত অপরাধ এসব মামলাগুলোর ক্ষেত্রে চার্জশিট গঠনের সময় কোন
মেজিস্ট্রেটে অথবা পুলিশের কোন পদস্থ কর্মকর্তার নজরদারিতে করা যেতে
পারে। এ ক্ষেত্রে চূড়ান্ত রিপোর্টের সময় ভিক্টিমের সাক্ষাৎ গ্রহণ করা
যেতে পারে। তাতে করে গোপনে চার্জশিট দাখিলের ফলে যে জটিলতা তৈরি হয় তা
কমে আসবে।
যৌন নির্যাতন তথা ব্যভিচার সর্বযুগে সর্বধর্ম মতে নিকৃষ্টতম পাপাচার।
তন্মধ্যে মুসলিম ধর্মগ্রন্থ আল-কুরআনের বিভিন্ন সূরার বিভিন্ন আয়াতে মহান
আল্লাহ ব্যভিচার সম্পর্কিত পাপের ভয়াবহতা ও এর কঠিন পরিণতি সম্পর্কে
সুস্পষ্টভাবে মানব জাতিকে সাবধান হতে বলেছেন। মহান আল্লাহতায়ালা বলেছেন,
‘তোমরা ব্যভিচারের ধারে কাছেও যেও না, কারণ এটা একটা অশ্লীল এবং জঘন্য
পন্থা।’ এ অপরাধ কোন দেশে কোন যুগেই বন্ধ ছিল না। এখনো নেই। কোন অপরাধ
কখনই নিঃশেষ করা যায় না কিন্তু নিয়ন্ত্রণ করা যায় । যে কোন মূল্যে
নিয়ন্ত্র করতে হবে। আমরা পুরুষরা (সবাই নন) নারীকে মানুষের মর্যাদা দেইনি
কখনই। নারীকে বানিয়েছি ভোগের বস্তু। এ মানসিকতা দূর করতে হবে। নারীকে
মর্যাদার আসনে বসাতে হবে। পর নারীকে কখনো মা, কখনো বোন, কখনো বা মেয়ে
ভাবতে হবে। তাদের উপর লুলুপ দৃষ্টি নয় মায়ামমতার দৃষ্টি দিতে হবে।
দেশে এত ধর্ষণ হচ্ছে কেন এবং তা রোধের উপায় কি? এ প্রশ্ন কাউকে করলে
অনেকেই বলেন, ভালো মেয়েরা ধর্ষণের শিকার হয় না; পোশাকের সমস্যার কারণে
মেয়েরা ধর্ষিত হয়। অনেকে আবার বলেন, বেহায়াপনা করে স্বল্প কাপড়ে রাস্তায়
ঘুরে বেড়ালে ধর্ষণ হবে না তো কি হবে? আর কোন আলেম বলবেন, ‘পর্দা প্রথায়
ফিরে আসলে ধর্ষণ আর হবে না।’ আবার অনেকে বলবেন, ‘কঠোর শাস্তি দিলে ধর্ষণ
কমবে।’ আমি এসব কোনটার পক্ষেই নই। সেই মক্কা-মদিনার আরব দেশে পর্দা মানা
হয় সেখানেও তো ভুরি ভুরি ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। তাদের শাস্তি প্রকাশ্য
শিরচ্ছেদ। কৈ সেখানেও তো ধর্ষণ বন্ধ হচ্ছে না। আমাদের দেশ থেকে যেসব
অসহায় নারী আরব দেশে যান তাদের আনেকেইতো দেশে অক্ষত ফিরে আসতে পারেন না।
তারা কোননা কোনভাবে নারী নির্যাতনের শিকার হনই। আমাদের দেশের নারী
শ্রমিকরা আরব দেশে গিয়ে পর্দায় থেকেও কেন যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন?
যৌন নির্যাতন বন্ধে আগে মানসিকতা বদলাতে হবে ।
নারী দেখলেই কেন ধর্ষণ করতে হবে? সব দোষ নারীর? সব দোষ পাশাকের? এমন
মানসিকতা কেন আমাদের। ধর্মে নারীকে পর্দা করতে বললেও পুরুষদেরর চোখ অবনত
রাখতে বলা বয়েছে। তবে শুধু নারীর দোষ কেন? নারীর রূপ যৌবন পুরুষকে মোহিত
করবে সেটাই স্বাভাবিক। তাই বলে তার উপর পশুর মতো ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে কেন?
ধর্ষণ কমাতে হলে আগে পুরুষের মাঝে মানবিক গুণাবলি জাগ্রত করতে হবে।
ধর্ষণরোধে আমাদের সচেতন হতে হবে। অবাধ মেলামেশার সুযোগ, লোভ-লালসা-নেশা,
উচ্চাভিলাষ, পর্নো সংস্কৃতির নামে অশ্লীল নাচ-গান, যৌন সুড়সুড়িমূলক
বই-ম্যাগাজিন, অশ্লির নাটক-সিনেমা ইত্যাদি কামোত্তেজনা মানুষকে প্রবলভাবে
ব্যভিচারে প্ররোচিত করে তা বর্জন করতে হবে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
সময়মত বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। ধর্মীয় শিক্ষা ও যৌন শিক্ষার গ্রহণ করতে
হবে। বাজে সঙ্গ ও নেশা বর্জন করতে হবে। পাশাপাশি নারীকেও শালীন হতে হবে।
যৌন উত্তেজক পোশাক বর্জন করতে হবে। প্রবল কামোত্তেজনা মানুষকে পশুতুল্য
করে ফেলে। ব্যাপকভাবে কামোত্তেজনা সৃষ্টিকারী উপকরণগুলোর কাছাকাছি চলে
গেলে নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের আর কোনো উপায়ই থাকে না।
ধর্ষণের ভয়াবহতা থেকে বাঁচতে হলে কেবল আইনের কঠোর প্রয়োগও কোনো কাজ হবে
না। এর জন্য প্রয়োজন জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে যার যার পারিবারিক বলয়ে
ধর্মানুশীলনে একনিষ্ঠতা, পোশাকের শালীনতা, অশ্লীল সংস্কৃতিচর্চার
পরিবর্তে শিক্ষণীয় বিনোদনমূলক ও শালীন সংস্কৃতি চর্চার প্রচলন
নিশ্চিতকরণ। আর এটা করতে হলে কেবল রাজনৈতিক বক্তৃতা, আইনের শাসন প্রয়োগ
বা ফতোয়া দিলেই চলবে না, সমাজের সর্বস্তরের মানুষ যার যার অবস্থানে থেকে
স্কুল-কলেজ মাদরাাসা-মক্তব-মসজিদ-মন্দির-গির্জা-প্যাগোডার নেতৃস্থানীয়
ব্যক্তিরা সমাজের অন্য বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীদের সমন্বয়ে উদ্যোগ গ্রহণ
করতে হবে। সর্বোপরি কঠোর শাস্তির বিধান ও প্রয়োগ নিশ্চত করতে হবে। তবেই
ধর্ষণ কমে আসবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।
লেখক- মীর আব্দুল আলীম, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

এই বিভাগের আরও খবর


ফেসবুকে আমরা