March 29, 2024, 5:27 am

অবৈবাহিক সম্পর্ক এবং ধর্ষণ ? সবটাই ধর্ষণ বলা যাবে না

মীর আব্দুল আলীম :পরকীয়া, ব্যভিচার, ধর্ষণ, পতিতাবৃত্তি, সমকামিতা এর সবই যৌনতা। কোনটা
সেচ্ছায়; আবার কোনটা জোড়পূর্বক। আইনে শাস্তির ভিন্নতাও আছে। ধর্ষণ আর
অবৈবাহিক আপোষের যৌনাচার ব্যভিচারের বিচার এক নয়। ধর্ষণ বলে সব যৌনতাকে
চালিয়ে দেয়া যাবে না। যেটা আমাদের দেশে হচ্ছে। চুন থেকে পান খসলেই
ফাঁসিয়ে দিতে আপোষের যৌনাচারকে ধর্ষন বলে অভিযোগ তোলা হয়। তা মোটেও সমচিন
নয়। কোনটাই সমর্থন যোগ্য অপরাধ নয়। শাস্তি যোগ্য সবটাই। তবে সাজার প্রকার
প্রকারভেদ আছে। আইনে পরকীয়া, ব্যভিচার, পতিতাগামীতার বিচার অবশ্যই হতে
হবে। যেন ধর্ষণের অপরাধে ফেলে সেসব বিচার না হয় সে বিষয়ে প্রশাসন খেয়াল
রাথকে হবে।বলতে বুঝায় বিবাহ বন্ধন ছাড়া অবৈধ পন্থায় যৌন তৃপ্তি লাভ
করাকে। এসব অবৈধ পন্থায় যৌন সম্ভোগ এদেশে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ইসলামী
শরীয়াতে সম্পূর্ণ হারাম। রাষ্ট্রিয় বিধান মতে একেকটার একেক ধরনের সাজা
রয়েছে। দেশে যেহেতুক ধর্ষণের সর্ব্বোচ্চা সাজা বলবৎ সেজন্য সব অপরাধকেই
ধর্ষণের আওতায় এনে অনেকেই আজকাল বাড়তে সুবিধা পেতে আদালতে যান। তখন আপোষে
যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হওয়া ব্যক্তিটিই সর্ব্বোচ্চ সাজার আওতায় আসেন।
একটু জেনে নেয়া যাক ধর্ষণ এবং অবৈবাহিক আপোষের যৌনাচার কি? এক নয়। সব
যৌনতাকে কোন মতেই ধর্ষণ বলা যাবে না, ধর্ষণ বলে চালিয়ে দেওয়াও ঠিকনা।
চুক্তিতে না মিললে পতিতা, কথায় না মিললে াাপোষে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হওয়া
নারী সহজেই তা ধর্ষণ বলে চালিয়ে দিচ্ছে। প্রমানও মিলছে ধর্ষণের, সাজাও
হচ্ছে ধর্ষণের। এদেশে তা হচ্ছে হরহামেশাই। ধর্ষণের সাজা ইসলামীক এবং
রাষ্ট্রিয় সাজা এক ধরনের আবার বিবাহোত্তর যৌনতা এবং বিবাহপূর্ব যৌনতার
সাজা আরেক ধরনের। আমাদের দেশে যৌনতা যেভাবেই হউক না কেন সবটাই ধর্ষণের
কাতারে ফেলা হয়। গোটা বিষয়টা ধর্ষণ নয়।
জানতে হবে ধর্ষণ কি? জোরপূর্বক অবৈবাহিক যৌনসঙ্গম হলো ধর্ষণ। পারস্পারিক
সম্মতিতে বিবাহিতের অবৈবাহিক যৌন সম্পক হলো পরকীয়া। বিবাহোত্তর যৌনতা এবং
বিবাহপূর্ব যৌনতা। দুজন অবিবাহিতের পারস্পারিক সম্মতিতে যৌনসঙ্গম হলো
ব্যভিচার। অর্থের বিনিময়ে যৌনসঙ্গম হলো পতিতাবৃত্তি। সমলিঙ্গীয়
ব্যক্তিদ্বয়ের পারস্পারিক সম্মতিতে যৌন সম্পর্ক হলো সমকামিতা। ধর্মীয়
দৃষ্টিতে পরিবারের সদস্য বা অবিবাহযোগ্য রক্তসম্পর্কের ব্যক্তির সঙ্গে
যৌনসঙ্গম হলো অজাচার। অমানব পশুর সঙ্গে যৌনসঙ্গমকে পশুকামিতা বলে। আমাদেও
দেশে এজাতীয় যৌনতায় লিপ্ত অনেক নারী পুরুষ। এ থেকে পরিত্রানের উপায় কি?

প্রশ্ন হলো, দেশে এত ধর্ষণ, যৌনাচার হচ্ছে কেন? তা রোধের উপায় কি? ধর্ষণ,
যৌন নির্যাতন এবং আপোষ যৌনতা বন্ধে আগে আমাদের মানসিকতা বদলাতে হবে। এসব
াপরাধ কমাতে হলে মানুষের মধ্যে মানবিক গুণাবলী জাগ্রত করতে হবে। ধর্ষণ,
ব্যভিচার রোধে সচেতন হতে হবে। অবাধ মেলামেশার সুযোগ, লোভ-লালসা-নেশা,
উচ্চাভিলাষ, পর্ণো-সংস্কৃতির নামে অশ্লীল নাচ-গান, যৌন উত্তেজক
বই-ম্যাগাজিন, অশ্লীল নাটক-সিনেমা ইত্যাদি থেকে সরে আসতে হবে। এগুলো
বর্জন করতে হবে। পর্ণোসাইটগুলো বন্ধ করতে হবে যেন মোবাইল কিংবা
কম্পিউটারে তা দেখা না যায়। ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। বাজে সঙ্গ ও
নেশা বর্জন করতে হবে। পাশাপাশি নারীকেও শালিন হতে হবে। যৌন উত্তেজক পোষাক
বর্জন করতে হবে। বলা বাহুল্য, প্রবল কামোত্তেজনা মানুষকে পশুতুল্য করে
তুলে। এর অন্যতম কারণ কামোত্তেজনা সৃষ্টিকারী উপকরণ। ফলে এগুলো থেকে
নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
ধর্ষণ, পরকীয়া, ব্যভিচার, পতিতাবৃত্তি, সমকামিতার ভয়াবহতা থেকে বাঁচতে
হলে কেবল আইনের কঠোর প্রয়োগে খুব বেশি কাজ হবে না। এর জন্য প্রয়োজন
জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে যার যার পারিবারিক বলয়ে ধর্মানুশীলনে একনিষ্ঠতা,
পোশাকের শালীনতা, অশ্লীল সংস্কৃতিচর্চার পরিবর্তে শিক্ষণীয় বিনোদনমূলক ও
শালীন সংস্কৃতি চর্চার প্রচলন নিশ্চিতকরণ। এটা করতে হলে কেবল রাজনৈতিক
বক্তৃতা, আইনের শাসন প্রয়োগের কথা বললেই হবে না, সমাজের সর্বস্তরের মানুষ
যার যার অবস্থানে থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় উপসনালয়ের নেতৃস্থানীয়
ব্যক্তি ও সমাজের বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীদের সমন্বয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করতে
হবে।
অপসংস্কৃতি আর ভিনদেশী সংস্কৃতির আগ্রাসন ধর্ষণ রোধের অন্তরায় মনে করা
হয়। অপসংস্কৃতি আমাদের সমাজকে কতটা ক্ষতবিক্ষত করছে, তা হাল আমলের পরকীয়
আর ধর্ষণের চিত্র দেখলেই আন্দাজ করা যায়। শুধু ধর্ষণ, পরকীয়া, ব্যভীচার
নয়, ধর্ষণের পর নৃশংস হত্যার ঘটনা অহরহ ঘটছে। অপরাধীর সাজা না হলে এ
জাতীয় অপরাধ বাড়তেই থাকবে। বিশ্বের যেসব দেশে এজাতীয় অপরাধ বাড়ছে তার
অন্যতম কারণ সাজা না হওয়া। এশিয়ার মধ্যে ভারত ও বাংলাদেশে ধর্ষণের অপরাধ
বেশি হয়ে থাকে। ধর্ষণের শিকার বেশিরভাগই নিন্ম ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর। যারা
উচ্চবিত্ত, সমাজের ওপর তলার মানুষ, তারা শিকার হচ্ছে কম। যারা
নিম্নবর্গের, তারা সম্ভবত এখনও ধর্ষণকে স্বাভাবিকভাবে নেয়। ভয়ে চুপ থাকে।
তাদের ধারণা, আইন আদালত করলে তাদের ভাগ্যে উল্টো বিপত্তি ঘটবে। এ
মানসিকতা এবং অন্যায় করে অপরাধির পার পেয়ে যাওয়ার কারণেই দেশে ধর্ষন বেড়ে
গেছে। দেশপ্রেম, সততা, নৈতিক মূল্যবোধ ইত্যাদির নেতিবাচক মানসিকতার
বিস্তৃতি ঘটছে। সমাজ থেকে মূল্যবোধ ও নীতি-নৈতিকতা হারিয়ে যাচ্ছে।
নিঃশর্ত ভালবাসা বা ভক্তি কমে যাওয়ার কারণে আমাদের গঠনমূলক মনোভাব বা
সৃষ্টিশীলতা নষ্ট হচ্ছে। এ কারণে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি শ্রদ্ধার পরিবর্তে
আমাদের ভোগের মনোভাব সৃষ্টি হচ্ছে।
বাংলাদেশে অবৈধ যৌনাচার দিনদিন বাড়ছে। এসব অপরাধ বৃদ্ধির জন্য সরকার ও
তার প্রশাসনের ব্যর্থতাই দায়ী বেশি। কারণ, অন্যায়কারী জঘণ্য অন্যায় করার
পরও আইনের যথাযথ প্রয়োগ হয় না। এজন্য অবশ্য রাজনৈতিক চাপও দায়ী। অনেক
ক্ষেত্রে আইন সমানভাবে কার্যকর হয় না। উচ্চ শ্রেণীর নারীরা নিরাপত্তার
ঘেরাটোপে বাস করেন বলে তারা এর শিকার কম হয়। আসল সমস্যাটা হলো একশ্রেণীর
কুরুচিপূর্ণ পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি। এমনকি শিক্ষাগত যোগ্যতাও তাদের এই
মানসিকতা বদলাতে পারে না। তা নাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মত স্থানে শিক্ষকের
হাতে ছাত্রী, ডাক্তারের হাতে রোগী ধর্ষণের শিকার হয় কি করে? এমন
সুশিক্ষিত মানুষ পরকীয়াও জড়াচ্ছে এমন খবর াামরা পত্রিকায় দেখতে পাই।
এযাবৎ কতগুলো পরকীয়া, ব্যাভিচার আর ধর্ষণ ও ধর্ষণজনিত হত্যাকান্ডের যথাযথ
বিচার সম্পন্ন হওয়েছে। গত দশ বছওে কটা। খুব কম। এর কারণ, সামাজি ও
রাজনৈতিক চাপ, চুড়ান্ত রিপোর্টে ঘাপলা নয়তো স্বাক্ষ্যপ্রমাণ প্রভাবিত করে
অপরাধী পার পেয়ে গেছে। উপরন্তু এর বিচার চাইতে গিয়ে বিচারপ্রার্থীরা
পাল্টা হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। এ অবস্থা থেকে আমাদের অবশ্যই বেরিয়ে আসতে
হবে।
উপরোক্ত বিষয়টি ধর্ষকদের পক্ষে ভেবে পাঠক ভুল করবেন না প্লিজ। ধর্ষণ যেমন
অপরাধ আবার অন্য অপরাধে ধর্ষণের দ্বায়ে ফাঁসিয়ে দেওয়াও অপরাধ। ধর্ষন করে
কোন ধর্ষক যেন পার না পায় সেটা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এদেশে
ধর্ষণ বে[েড়ছে এটা বলতেই হবে। এটাও স্পষ্ট যে ধর্ষকদেও প্রায় ক্ষেত্রেই
বিচার হচ্ছে না। ১৯৯৫ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ বিশেষ বিধান
আইন করা হয়। পর্যায়ক্রমে ২০০০ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন করা হয়।
২০০৩, ২০১৯ সালে এ আইন আবার সংশোধন করা হয়। ধর্ষণের শাস্তি কত ভয়ানক, তা
অনেকেই জানেন না। নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের ৯ ধারায় ধর্ষণের বিচার হয়।
এ আইনে ধর্ষণের সর্বনিম্ন শাস্তি পাঁচ বছরের কারাদন্ড এবং সর্বোচ্চ
শাস্তি মৃত্যুদন্ড করা হয়েছে। আইনের ৯(১) ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো
পুরুষ কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে, তাহলে সে যাবজ্জীবন সশ্রম
কারাদন্ডে দন্ডনীয় হবে। এ ছাড়া অর্থদন্ডও দিতে হবে। ৯(২) উপধারায় বলা
হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি কর্তৃক ধর্ষণ বা ওই ধর্ষণ-পরবর্তী তার অন্যবিধ
কার্যকলাপের ফলে ধর্ষিত নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে, তাহলে ওই ব্যক্তির
মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ড দন্ডনীয় হবে। অতিরিক্ত এক লাখ
টাকা অর্থদন্ডে দন্ডিত হবে। উপধারা ৯(৩)-এ বলা হয়েছে, যদি একাধিক ব্যক্তি
দলবদ্ধভাবে কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে এবং ধর্ষণের ফলে ওই নারী বা
শিশুর মৃত্যু ঘটে বা তিনি আহত হন, তাহলে ওই দলের প্রত্যেক ব্যক্তি
মৃত্যুর জন্য দায়ী। যদি কোনো ব্যক্তি কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে
মৃত্যু ঘটানোর বা আহত করার চেষ্টা করে, তাহলে ওই ব্যক্তি যাবজ্জীবন সশ্রম
কারাদন্ডে দন্ডিত হবে ও এর অতিরিক্ত অর্থদন্ডেও দন্ডিত হবে। বলা বাহুল্য,
ধর্ষণের আইন আছে ঠিকই তবে তার যথাযথ প্রয়োগ নেই বললেই চলে। আইন যারা
প্রয়োগ করবেন তারা ঐ আইনের পথে হাঁটে না। কখনো অর্থের লোভ কখনোবা হুমকি
ধমকিতে শুরুতেই গলদ দেখা দেয়। মামলার চার্জসিট গঠনের সময় ফাঁক ফোকর থেকে
যায়। তাই আদালতের রায়ে ধর্ষিত কিংবা নির্যাতনের শিকার সঠিক বিচার থেকে
বঞ্চিত হয়। এসব মামলার ক্ষেত্রে চার্জসিট গঠনের সময় কোন ম্যাজিস্ট্রেট
অথবা পুলিশের কোন পদস্থ কর্মকর্তার নজরদারি করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে
চূড়ান্ত রিপোর্টের সময় ভিক্টিমের স্বাক্ষাৎকার গ্রহণ করা যেতে পারে। এতে
চার্জসিট দাখিলের ক্ষেত্রে যে জটিলতা তৈরি হয় তা কমে আসবে।
নারীদের জন্য ঘরের বাইরে নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। এটা স্পষ্ট যে
বিচারহীনতার সংস্কৃতিই অপরাধীকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ
গড়ে তোলা জরুরী। এজন্য সততা, আন্তরিকতা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে কার্যকর
পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিৎ। সেসঙ্গে এক ধরনের অপরাধের জন্য অপরাধীকে অন্য
ধরনের অপরাধে সাজা যেন ভোগ না করতে হয় তা সরকার সংশ্লিষ্টদেও সজাগ থেকে
দায়িত্বশীল ভুমিকা পালন করতে হবে। পরকীয়া, ব্যভিচার, ধর্ষণ, পতিতাবৃত্তি,
সমকামিতা এসব যৌনতা বন্ধে এবং নারী নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য যা যা
করা দরকার প্রশাসন তা সুনিশ্চিত করবে- এটাই সকলের প্রত্যাশা।
✒ লেখক : সাংবাদিক, কলামিষ্ট।

এই বিভাগের আরও খবর


ফেসবুকে আমরা