April 18, 2024, 5:56 pm

বেশি করে ঘি খান, তেলের উপর চাপ কমান”  চাল নয় তেলের দামও আকাঁশচুম্বি : এবার কি বলবেন?  পণ্যমূল্য আকাঁশচুম্বি : এবার কি বলবেন?

মীর আব্দুল আলীমঃ চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় কয়েক বছর আগে জনৈক মন্ত্রী বলেছিলেন-“বেশি করে
আলুখান, ভাতের উপর চাপ কমান”। তেলের দাম আকাঁশচুম্বি এখন তিনি কি বলবেন?
ধারাবাহিকতায় বাক্যটা হয়তো এমনই আসবে-“ বেশি করে ঘি খান, তেলের উপর চাপ
কমান”। পুরোপুরি সিন্ডিকেটের কব্জায় চলে গেছে দেশের ভোজ্যতেল, চাল,
পিয়াজসহ নিত্য পণ্যের বাজার। ব্যবসায়ীরা একে অপরের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে
কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে বাজার থেকে অতিরিক্ত মুনাফা তুলে নিচ্ছেন। চেষ্টা
করলেও কিছুতেই তা সরকার নিয়ন্ত্রনে আনতে পারছে না। সরকার সংশ্লিষ্টদের
হম্বিতম্বি কোনই কাজে আসছে না। শুধু চাল তেল নয় মাছ, মাংস, ডিম, দুধ,
পিয়াজ সব কিছুর দাম এখন উর্দ্ধে। তাতে উচ্চবিত্তদের কোন সমস্যা নেই।
মধ্যবিত্ত আর গরিবের যত জ¦ালা।
পাঠক যারা ঢাকায় থাকেন তাদের অধিকাংশই আইজ উদ্দিকে বোধ করি নামে চেনেন।
দু’দশক আগে কেবল দেয়াল লিখনের মাধ্যমে আইজ উদ্দিন ঢাকাবাসীর কাছে
অল্পসময়ে বেশ পরিচিত হয়ে ওঠে ছিলেন। বোধ করি চেহারায় আইজ উদ্দিনকে কেউ
চেনে না। ১৯/২০ বছর আগে ঢাকার বিভিন্ন দেয়ালে লেখা থাকতো “কষ্টে আছে আইজ
উদ্দিন”। আনাড়ি হাতে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়সহ রাজধানীর অনেক দেয়াল জুড়ই লেখা
থাকত তা। এসব লেখা মুছে গেছে এরই মধ্যে। আইজ উদ্দিন বেঁচে আছেন কিনা তাও
জানিনা। তবে ধারনা করি, বড্ড কষ্টে থাকা আইজ উদ্দিন বেঁচে থাকলে হয়তো
তিনি তার ঐ কর্ম এখনও চালিয়ে যেতেন। আইজ উদ্দিন বেঁচে থাক, আর নাই থাক
এরই মধ্যে গোটা দেশে হাজারো আইজউদ্দিনের জন্ম হয়েছে এ কথা নিশ্চিত বলা
যায়। যারা চাকুরী করেন তারা গ্যাস, বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি, বাসাভাড়া,
পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধি, সন্তানের শিক্ষা ব্যায় বৃদ্ধিসহ নিত্যপন্যেরর আকাশ
ছোঁয়া উচ্চ মূল্যের নিস্পেষনে অনেকেই আজআইজ উদ্দিন বনে গেছেন। যারা
ব্যবসা বাণিজ্য করেন তাদের অনেকেরই ব্যবসা এখন আগের গতি নেই। উৎপাদন,
বেচাকেনা কমে গেছে। ব্যবসা বানিজ্যে স্থ্যবিরতা, গার্মেন্টস,
শিল্পকারখানা একে একে বন্ধ হয়ে যাওয়া, আমজনতার নিত্য টানাপোড়েন, সড়ক
মৃত্যু, ধর্ষণ, গুম, খুনসহ নানা কারনে দেশের মানুষ সুখে নেই; শান্তিতে
নেই।
একটু বেশি রোজগার আর সন্তানদের ভালো শিক্ষার আশায় মুখ গুঁজে ঢাকা
মহানগরীসহ দেশের বিভিন্ন জেলা শহরে থাকতে হয় হাজারো চাকরিজীবী আইজ
উদ্দিনদের। গত ৫ বছরে জাতীয় পর্যায়ে পারিবারিক আয় বেড়েছে ৫৯ শতাংশ, আর
খরচ বেড়েছে ৮৪.৫ শতাংশ। পারিবারিক ভোগ-ব্যয়ের অর্ধেকেরও বেশি প্রায় ৫৫
শতাংশ জুড়ে রয়েছে খাদ্য। সবচেয়ে কম আয়ের পরিবারে খাদ্যের পেছনে খরচ হয় ৭২
শতাংশ, সবচেয়ে বেশি আয়ের পরিবারে খাদ্যবহির্ভূত খাতে খরচ ৫৯ শতাংশ। যেসব
পরিবারের আয় মাঝামাঝি পর্যায়ে, খাদ্যের পেছনে মোট সংসার খরচের ৬১ থেকে ৬৫
শতাংশ ব্যয় হয় তাদের। সবচেয়ে বেশি দরিদ্র পরিবারের সঙ্গে সমাজের উঁচু
স্তররের মানুষের আয়ের বৈষম্য বেড়েছে। তবে পাঁচ বছরে দরিদ্র্র পরিবারের আয়
খানিকটা বাড়লেও ধনীদের আয় কমেছে বলে এক জরিপে উল্লেখ করা হয়েছে।
ব্যবসায়ীরা নানা ফন্দি ফিকিরসহ ডলারের দাম বাড়ার অজুহাতে পণ্যমূল্য
বাড়িয়ে তাঁর মুনাফা ঠিক রাখতে পারেন। রিকশাওয়ালারা চালের দাম বাড়ার
অজুহাত দেখিয়ে ভাড়া বাড়িয়ে নিতে পারেন। কিন্তু চাকরিজীবী আইজউদ্দিনরা
তাঁদের বেতন চাইলেই বাড়াতে পারেন না। একটি পদের পেছনে যেখানে হাজার হাজার
আবেদনপত্র পড়ে, সেখানে এক চাকরি ছেড়ে অন্য চাকরিতে ঢোকার সুযোগও নেই। ফলে
একটু ভালো করে বাঁচার আশাটি আর তাঁদের পূরণ হচ্ছে না। ঢাকা মহানগরীতে
সীমিত আয়ের মানুষের বসবাসের অর্থ দাঁড়িয়েছে ‘শুধু বেঁচে থাকার জন্য বেঁচে
থাকা।’ এসব মানুষের এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা আবাসন। একসময় সরকারি
কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসনের নিশ্চয়তা ছিল। এখন তাঁদের অর্ধেকেরও সেই
সুযোগ নেই। বেসরকারি খাতের ব্যাপক প্রসারের সঙ্গে ঢাকায় যে বিপুলসংখ্যক
মানুষের জীবিকার ব্যবস্থা হয়েছে, নিয়োগকারীদের পক্ষ থেকে তাঁদের জন্যও
আবাসনের কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি। ফলে শ্রমিক-কর্মচারী থেকে শুরু করে
পদস্থ কর্মকর্তা পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি নির্বিশেষে সর্বস্তরের চাকুরের
নিজের থাকার ব্যবস্থা নিজেরই করতে হয়। উচ্চ আয়ের মানুষজন যেখানে প্লট ও
ফ্ল্যাট কেনার চেষ্টা করছে, মধ্য ও নিম্ন আয়ের মানুষজন তেমনি সাধ্যের
মধ্যে ভাড়া বাসা খুঁজছে। চাহিদা বাড়ার কারণে বল্গাহীনভাবে বেড়ে চলেছে
বাসা ভাড়া, জমি ও ফ্ল্যাটের দাম। আবাসনের তীব্র সংকটের কারণে মানুষের
আয়ের অর্ধেকই চলে যাচ্ছে বাড়ি ভাড়া, জমি বা ফ্ল্যাটের কিস্তি পরিশোধ বা এ
বাবদ নেওয়া উচ্চ সুদে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধে। আবাসন সুবিধা সরকারি
কর্মকর্তা-কর্মচারিদের চাকরির শর্তের মধ্যেই রয়েছে। তবে অপ্রতুল জোগানের
কারণে সবাই এ সুযোগ পান না। ব্রিটিশ আমলে নতুন একটি থানা তৈরির সঙ্গে
সঙ্গে পুলিশদের থাকার ব্যবস্থা করা হতো। থানার লাগোয়া কোয়ার্টার থাকত।
আগে ঢাকা শহরে থানা ছিল ৯টি, এখন ৪৭। কিন্তু পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যদের
থাকার ব্যবস্থা নেই। ঢাকায় সব শ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য
ফ্ল্যাট রয়েছে ১২ হাজার ৪৫০টি, যা চাহিদার মাত্র ৭ শতাংশ। ৯৭ ভাগ
কর্মকর্তা-কর্মচারীকেই নিজেদের উদ্যোগে থাকার ব্যবস্থা করতে হয়। তাদের
বেতনের সঙ্গে বাড়িভাড়া যা দেওয়া হয় সে টাকায় ঢাকায় বাসা ভাড়া পাওয়া যায়
না।
বিভিন্ন সময় জ্বালানি তেলের দাম লিটারে বেড়েছে, তরলায়িত প্রাকৃতিক
গ্যাসের (সিএনজি) দাম বেড়ে ইউনিটপ্রতি ১৬ টাকা থেকে ৩০ টাকা হয়েছে। ৬/৭
দফা বেড়েছে বিদ্যুতের দাম। এক বছরেই ডলারের দাম বেড়েছে প্রায় ২০ শতাংশ।
ক্যাবের মতে গত দুই বছরে পারিবারিক বিদ্যুতের দাম বেড়েছে প্রায় ২৩ শতাংশ।
বাস ভাড়া বেড়েছে ৩৫ শতাংশ। এর বিপরীতে সিএনজিচালিত অটোরিকশা ভাড়া
নিয়ন্ত্রণে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে সরকার। বাসের সর্বনিম্ন ভাড়া কার্যকর
করা যায়নি কখনো।
এটা বলতেই হয় দ্রব্যমূল্য সীমিত রাখার নির্বাচনী প্রতিশুতিগুলো এখনো পূরণ
করতে পারেনি সরকার। দরিদ্র মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি
সম্প্রসারিত হয়েছে, কম দামের সরকারি চাল ও আটা কিনতে পারছেন নিম্ন আয়ের
মানুষ। সরকারি চাকরিজীবীদের অনেকে রেশন পাচ্ছেন। কিন্তু কোনো রকম
সুবিধাহীন ঢাকার মধ্য আয়ের মানুষের কষ্ট শুধুই বেড়েছে। গ্রামে ফিরে
যাওয়ার কোনো উপায় না থাকায় যানজট, পানিহীনতা, জলাবদ্ধতা, গ্যাস সংকট,
লোডশেডিং, ভেজাল খাবারসহ নানা কষ্টের মধ্যেও ঢাকায় পড়ে আছেন তাঁরা। প্রথম
শ্রেণীর সরকারি গেজেটেড কর্মকর্তার চাকরি যে বেকারদের কাছে ব্যাপক
আকর্ষণীয় তা পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা দেখলেই বোঝা যায়। কিন্তু
বেতনটা মোটেও আকর্ষণীয় নয়। কারণ, বর্তমান আক্রার বাজারে মাসশেষে বেতনের
১৬ হাজার টাকায় অন্তত ঢাকায় সংসার চালানো সম্ভব নয়। তার ওপর বছরশেষে
যেখানে বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি হয় মাত্র সাড়ে সাত শ টাকার মতো। শতকরা হিসাব
করলে দেখা যায়, বছরশেষে প্রথম শ্রেণীর সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন পাঁচ
শতাংশেরও কম বাড়ে। কিন্তু কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব)
হিসাবে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ১১ দশমিক ৯৬ শতাংশ। বাড়তি ব্যায় সামাল
দিতে পাছেনা সাধারন আয়ের মানুষ। বাজার করতে গেলে বাড়ি ভাড়া থাকে না,
সন্তানের শিক্ষার ব্যায় মিটাতে পারেনা। অনেকে বাধ্য হয়ে উচ্চ সুতে ঋণ
নিয়ে তা শোধ করতে পারছেন না।
নিম্ন আয়ের মানুষ, যারা রিকশা বা অটোরিকশা চালান, তাঁরা তাদের মতো করে আয়
বাড়িয়ে নিচ্ছেন। তবে তারাও ভালো নেই। আয় কমলেও উচ্চ আয়ের মানুষদের সমস্যা
হচ্ছে কম। বেশী বিপদে রয়েছেন শুধু সনাতনি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ, যাদের
জীবনবোধ ভিন্ন। তাদের মাসিক আয়ের ৬০ ভাগ চলে যায় বাড়িভাড়া, আর ২০ ভাগ
খাবারে। দুই বাচ্চার পড়াশোনা আর স্কুলে যাতায়াতে খরচ হয় আয়ের ১০-১৫ ভাগ।
তারপর রয়েছে চিকিৎসা। খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়লে হৈচৈ বেশি হয়। কিন্তু
সবচেয়ে বেশি চাপ পড়ে বাড়িভাড়া বৃদ্ধির কারণে। সরকারের উচিত কঠোর আইন করে
বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ করা। আইন থাকলেও কখনো এর প্রয়োগ হয়নি। ঢাকায়
বসবাসকারীর সংখ্যা এক কোটি হলে তাদের জন্য কমপক্ষে ২০ লাখ ফ্ল্যাটের
দরকার। কিন্তু গত ২০ বছরে বেসরকারি আবাসন ব্যবসায়ীদের পক্ষে দুই থেকে তিন
লাখের বেশি ফ্ল্যাট নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। এই সময়ে ঢাকায় বসবাসকারীর
সংখ্যা যে হারে বাড়ছে, আবাসন ব্যবস্থা তার সিকিভাগও বাড়েনি। সরকার ২২
হাজার ফ্ল্যাট নির্মাণের যে উদ্যোগ নিয়েছে তা আবাসন সমস্যা সমাধানে তা
কোনো ভূমিকাই রাখতে পারবে না। প্রবালের মতে, এখন ঢাকা শহরে প্রতিবছর এক
লাখ থেকে দেড় লাখ ফ্ল্যাটের চাহিদা বাড়ছে। তার বিপরীতে বেসরকারি খাতে
জোগান দেওয়া সম্ভব হচ্ছে ২২ থেকে ২৩ হাজার ফ্ল্যাট। ঢাকা শহরে ফ্ল্যাটের
দাম ৮৫ ভাগ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে।
মানুষের একদিকে বাসস্থান সমস্যা প্রকট, অন্য দিকে পারিবারিক ব্যয় বহুগুণে
বেড়ে যাওয়ায় মহা সংকটে পরেছে। সন্ত্রাসী কর্মকান্ড গড়ে কমলেও বেড়েছে
ধর্ষণ, হত্যা, সড়ক খুন। জনগনের কথা মাথায় রেখে যে কোন মূল্যে দেশের আইন
শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনতে হবে। এ ছাড়া পণ্য মূল্যসহ অন্যান্য ব্যয়
যাতে কমে সেদিকে সরকারের নজরদারীর বিকল্প নেই। সরকারের কার্যকর পদক্ষেপই
পারে এ ক্ষেত্রে সফলতা এনে দিতে। সন্ত্রাস দমনের পাশাপাশি কঠিনভাবে বাজার
তদারকি,বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রনসহ সকল ক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ গুলো
সদাই সজাগ থাকতে হবে।
৥ লেখক- মীর আব্দুল আলীম, সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সমাজ গবেষক।

এই বিভাগের আরও খবর


ফেসবুকে আমরা