April 19, 2024, 11:37 pm

লাইসেন্স ছাড়াই ক্রিস্টাল ডায়াগনস্টিক সেন্টার এ্যান্ড হাসপাতালে সেকমো ডাক্তারের অপারেশন শুরু

শামীম আখতার, বিভাগীয় প্রধান (খুলনা) কেশবপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এর সামনে বেসরকারি ক্রিস্টাল ডায়াগনস্টিক সেন্টার এ্যান্ড হাসপাতালের মালিক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে অনলাইনে লাইসেন্সের আবেদন করেই প্রতিষ্ঠানে সিজারিয়ান অপারেশন কার্যক্রম শুরু করেছে। স্বাস্থ্য বিভাগের কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে প্রতিষ্ঠানের মালিক ফিরোজ কবির একজন সেকমো ডাক্তার হয়ে রোগীদের শরীরে চালাচ্ছে অস্ত্রোপচার।
উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগের কর্তৃপক্ষের চোখের সামনে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম শুরু হলেও এব্যাপারে পর্যাপ্ত নজরদারি কিংবা মান যাচাইয়ে তেমন কোনো তদারকি নেই। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে হাসপাতালের মালিকরা রোগীদের প্রতারণার ফাঁদে ফেলে সেবার নামে ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রমরমা বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। প্রসূতি মায়েদের প্রকৃত ডাক্তার দ্বারা সিজারিয়ান অপারেশন না করায় একাধিক শিশু ও মায়ের মৃত্যুর ঘটনা ঘটতে পারে এবং সাধারণ মানুষ টাকা খরচ করেও উপযুক্ত চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হবে বলে এমনটাই দাবী এলাকার সচেতন মহলের।
জানা গেছে, কেশবপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এর সামনে নির্মাণাধীন একটি ভাড়া করা ঘরের নীচ তলায় ক্রিস্টাল ডায়াগনস্টিক সেন্টার নামে একটি বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। পরবর্তীতে দ্বিতীয় তলায় ক্রিস্টাল ডায়াগনস্টিক সেন্টার এ্যান্ড হাসপাতাল নামকরণ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে অনলাইনে লাইসেন্সের অনুমোদনের আবেদন করেন। প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন প্রক্রিয়াধীন থাকা অবস্থায় গত ২০ নভেম্বর প্রতিষ্ঠানের উদ্বোধন করেন।
প্রতিষ্ঠানটি ৫জন অংশীদারিত্বে গড়ে তুলেছেন। তারা হলেন আশিকুর রহমান, আল ফাত্তা, আব্দুস সামাদ, সেকমো ডাক্তার ফিরোজ কবির ও তার স্ত্রী।
কম্পিউটারাইজড, পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল ও অত্যাধুনিক নামে নামিদামী চিকিৎসকদের নাম সংবলিত চোখ ধাঁধানো ব্যানারসহ ডিজিটাল সাইনবোর্ড ব্যবহার। বে-সরকারী ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের বসার কথা মাইকিং করে প্রচার-প্রচারণা চালানো হলেও তাদের কেউ কেউ মাসে দু-একবার এসে রোগী দেখে চলে যায়। হাসপাতালে নিয়মিত কোনো চিকিৎসক না থাকায় হাতুড়ে টেকনিশিয়ানরা অনেক ক্ষেত্রেই দিচ্ছেন মনগড়া রিপোর্ট। শুধু তাই নয়, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের নাম ভাঙিয়ে প্রয়োজনে বিনা প্রয়োজনে পরীক্ষা-নিরীক্ষা দিয়ে রোগীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। স্থানীয় কিছু সন্ত্রাসী প্রকৃতি ব্যক্তিদের সুবিধা দিয়ে তাদের ছত্রছায়ায় এ অবৈধ অনুমোদন বিহীন ক্লিনিকের ব্যবসা করে অসহায় রোগীদের ফাঁদে ফেলে প্রতি মাসে সেকমো ডাক্তার কামিয়ে নিচ্ছে লক্ষ-লক্ষ টাকা এবং সমাজে বুক ফুলিয়ে চলছে। এই প্রতিষ্ঠানে উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের অসহায় মানুষ রোগ নিরাময়ের জন্য এসে অপচিকিৎসার জালে জড়িয়ে পড়ছে। বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত সহজ-সরল অসহায় মানুষগুলো প্রতিনিয়তই তাদের পাতা ফাঁদে পড়ে অনেকেই সর্বহারা হচ্ছেন। আবার কখনো ভূক্তভোগী রোগীর স্বজনরা প্রতিবাদ জানালে ওই সময় সন্ত্রাসী দ্বারা তাদের কে ভয়ভীতি দেখিয়ে প্রতিহত করা হয়। ক্লিনিকের মালিক ফিরোজ কবির নিজে একজন সেকমো ডাক্তার, তিনি সেকমো ডাক্তার হয়েও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রসূতি মায়েদের সিজারিয়ান অপারেশন করে সন্তান ও মায়ের মৃত্যু হয়েছে এমন অভিযোগ ভুক্তভোগী রোগীর স্বজনদের।

এমন অভিযোগের ভিত্তিতে গত মঙ্গলবার সকালে সরেজমিনে গেলে সেখানে কোনো চিকিৎসক এবং ডিপ্লোমা নার্স দেখা না মিললেও রিসিপশনে দ’জনকে দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায়। কয়েকটি ওয়ার্ডে রোগীদের জন্য বেড বিছানো রয়েছে। একটি রুমে সুমাইয়া খাতুন (১৮) সিজারিয়ান রুগীকে বেডে শুয়ে থাকতে দেখা যায়। ওই সময় রুগীর পাশে থাকা স্বজনদের সাথে কথা বলে জানা যায় প্রতিষ্ঠানের মালিক সেকমো ডাক্তার ফিরোজ কবির তাদের মেয়েকে সিজারিয়ান অপারেশন করেছে। এর আগেও আমাদের দুই মেয়েকে অন্য প্রতিষ্টানে ওই ডাক্তার সিজার করেছে বলেও জানান তারা। তবে কত টাকার চুক্তিতে এই সিজিরিয়ান করা হয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে মেয়ের মা ও বাবা বলেন, চুক্তির টাকা পয়সার বিষয় আমরা কিছু জানিনা। চুক্তির বিষয় আমাদের জামাই বাবলু মীর সবকিছু জানে।

ক্রিস্টাল ডায়াগনস্টিক সেন্টার এ্যান্ড হাসপাতালের ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করা শফিকুর রহমান মিলন জানান, গত ২০ ডিসেম্বর (সোমবার) রাতে ফিরোজ কবির ওই রোগীর সিজারিয়ান অপারেশন করেছেন। সিজারিয়ান অপারেশন করার সময় অ্যানাস্থেসিয়া ডাক্তার কে ছিলেন সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে তিনি কোন সৎ উত্তর দিতে পারিনি।
সিজারিয়ান অপারেশন করার বিষয়ে ক্রিস্টাল ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক ও সেকমো ডাক্তার ফিরোজ কবিরের কাছে মুঠোফোনে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি ওই রোগীর অপারেশন করেছি এবং আমার সাথে এমবিবিএস ডাক্তার মুস্তাফিজুর রহমান ছিলেন। তিনি চায়না থেকে এমবিবিএস পাশ করে এসেছেন। এখনো তিনি কোন প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করেন না বলে জানিয়েছেন।
এব্যাপারে ক্রিস্টাল ডায়াগনস্টিক সেন্টারের আরেক মালিক আশিক রহমানের সাথে মুঠোফোনে কথা হলে তিনি বলেন, আমাদের ডায়াগনস্টিক সেন্টারের লাইসেন্স আছে। হাসপাতালের লাইসেন্সের জন্য অনলাইনে আবেদন করা হয়েছে। আবেদনের প্রক্রিয়াধীন অবস্থায় অপারেশন কার্যক্রম চালানো যায় বলে এমনটাই বলেছেন তিনি।

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আলমগীর হোসেন বলেন, লাইসেন্স না পেয়ে কোন ভাবে হাসপাতাল চালু করা যাবে না এমনকি লাইসেন্স প্রক্রিয়াধীন থাকলেও চালু করা যাবে না। অবৈধভাবে কেউ যদি ক্লিনিক বা হাসপাতালের কার্যক্রম চালায় সেটি বন্ধ করে দেওয়া হবে। তিনি আরো বলেন, এ উপজেলায় ৬টি প্রাইভেট ক্লিনিক (হাসপাতাল) ও ৯ টি ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। সব প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স রয়েছে। কিছু প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স এর মেয়াদ শেষ হওয়ায় নবায়ন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার এম এম আরাফাত হোসেন বলেন, অনুমোদন ছাড়াই নতুন হাসপাতালের অপারেশন কার্যক্রম শুরুর বিষয়টি আমরা তদন্ত করে দেখবো। এমন অপরাধমূলক কার্যক্রম করলে তাদের ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

যশোরের সিভিল সার্জন ডা. শেখ আবু শাহীন বলেন, কোনো বেসরকারী ক্লিনিক বা হাসপাতাল বৈধ কাগজপত্র ছাড়া অপারেশন করতে পারেনা। সেকমো বা হাতুড়ে ডাক্তার রোগীদের সিজারিয়ান অপারেশন করতে পারেনা। যদি এমন কাজ করে থাকে সেটি আইনগত অপরাধ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিনা অনুমোদন ছাড়া এমন অপরাধমূলক কর্মকান্ড করে থাকে তাহলে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনগত কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

এই বিভাগের আরও খবর


ফেসবুকে আমরা